০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

গুজব থামাতে মত প্রকাশে বাধা দেয়া যাবে না

এস. এ টিভি
  • আপডেট সময় : ১১:৩৮:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ১৭০৮ বার পড়া হয়েছে
এস. এ টিভি সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গণতান্ত্রিক নির্বাচন একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া, যা নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে৷

বিশ্বের অনেক জায়গার মত বাংলাদেশেও এই গণতান্ত্রিক নীতিগুলোকে মিথ্যা, অতিরঞ্জিত বা পরস্পরবিরোধী তথ্যের কৌশলগত অবস্থান এবং প্রচার গণতান্ত্রিক নির্বাচনী পরিবেশেকে দুর্বল করবার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়৷

ইচ্ছাকৃত প্রতিবেদন কিংবা প্রবন্ধের মধ্যে ঝাপসা সত্য এবং কল্পকাহিনী ভোটারদের বিভ্রান্তি বাড়ায় এবং সত্যভিত্তিক রাজনৈতিক বিতর্ককে অবমূল্যায়ন করে৷ একইসঙ্গে গুজব, শ্রবণ এবং সাইবার পরিসরে হয়রানি এবং তথ্যের কারসাজি অনেকসময় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে ব্যবহার করা হয়৷ এছাড়াও, সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ নষ্ট করে সামাজিক বিভেদ তৈরি করে দেয় এবং নারী, শিশু ও প্রান্তিক মানুষদের আরো প্রান্তিক করে দেয়৷

শেষ পর্যন্ত ভোটার ও নাগরিকদের ভোটের প্রতি আগ্রহ কমে আসে এবং নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত সংস্থাগুলোর ওপর আস্থা কমে আসে৷ এতে রাজনৈতিক পরিবেশ যেমন অস্থিতিশীল হয়, নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতার আশঙ্কাও বেড়ে যায়৷ এই সুযোগে কর্তৃত্ববাদীদের সামনে আসার সুযোগ যেমন বেড়ে যায়, তেমনি গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়৷

ভুল এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কৌশলটি বড় পরিসরে আলোচনায় আসে ২০১৬ সালে৷ ওই বছর ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করায় আন্তর্জাতিক পরিসরে মনোযোগ আকর্ষণ করে রাশিয়া৷ একইভাবে, রাশিয়া বা চীনের নির্বাচনেও এমন ঘটনা দেখা গেছে৷

নির্বাচনের সময় ‘বিভ্রান্তি’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ কিছু দেশ ভুল তথ্যের প্রেক্ষাপটে ভুয়া খবর ছড়িয়ে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে প্রভাবিত করছে৷ অন্যান্য দেশের মত সামাজিক যোগাযোগ এবং অন্য যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো বাংলাদেশে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

ভুল তথ্য (misinformation), বিভ্রান্তিমূলক তথ্য (Disinformation) এবং ম্যালিনফর্মেশন (malinformation) মিলিয়ে এমডিএম (MDM)৷ বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ এই এমডিএম-এর মাধ্যমে প্রাভাবিত হচ্ছে৷ মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এবং অ্যামপ্লিফিকেশন নেটওয়ার্কের মতো নতুন প্রযুক্তি প্রকৃত তথ্যকে বিকৃত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে৷

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য, যেমন ডিপফেকস ছড়িয়ে দিতে পারে৷ ডিপফেকগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ছবি, অডিও এবং ভিডিওকে বোঝানো হয়, যা আসল চিত্র, অডিও বা ভিডিওর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়৷ অন্যদিকে, ভুল তথ্য বলতে এমন তথ্য বোঝায় যা ক্ষতি করার উদ্দেশে নয়৷ বিভ্রান্তিকর তথ্য বলতে মিথ্যা তথ্যকে বোঝায় যেগুলো  ক্ষতির কারণ বা মানুষ, সংস্থা এবং দেশগুলোকে ভুল পথে পরিচালিত করার উদ্দেশে করা হয়৷ ম্যালিনফরমেশন এমন তথ্যকে বোঝায় যা সত্য থেকে উদ্ভূত হয়, কিন্তু প্রায়ই অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়৷

২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সামাজিক মিডিয়া গুজব বিশ্লেষণ করেছেন মো. সাইদ আল-জামান৷ সেখানসে গুজবের সাতটি বিষয়ভিত্তিক বিভাগ তুলে ধরা হয়৷ এগুলোর মধ্যে প্রথমে আছে রাজনৈতিক (৩৪.৩%), তারপরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ( ১৬.০%), অপরাধ ও মানবাধিকার (১১.০০%) এবং ধর্মীয় (১১.০%)৷

নির্বাচন, রাজনৈতিক দল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যা, প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা, উন্নয়নপ্রকল্প এবং রাজনৈতিক নেতারা হলেন রাজনৈতিক গুজবের সাধারণ বিষয়৷ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা ও মৃত্যু, সংক্রমণ, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং অ্যাকাডেমিক দুর্নীতি ও অসততা সবই স্বাস্থ্য ও শিক্ষার গুজবের সাধারণ বিষয়৷ অপরাধ-সম্পর্কিত গুজবগুলো প্রায়ই নরহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, জাতিগত নির্মূল এবং সহিংসতাকে কেন্দ্র করে৷ ধর্মীয় গুজবগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বক্তৃতা, ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা, ধর্মীয় নিয়ম ও প্রবিধান এবং ঐতিহাসিক ধর্মীয় ঘটনাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে৷ এটি লক্ষণীয় যে ধর্মীয় এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক গুজবগুলো সব গুজবের ২০.৯৯ শতাংশের জন্য দায়ী, সম্ভবত রাজনৈতিক গুজবের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ৷ এর থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে ধর্ম সংক্রান্ত গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি সহজ লক্ষ্য৷

এই কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, ভুল এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বাংলাদেশের কিছু মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারকে প্রভাবিত করে৷ এগুলোর মধ্যে মধ্যে রয়েছে মত প্রকাশ, সভা, সমাবেশের স্বাধীনতা, জীবনের অধিকার, বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে সুরক্ষা, গ্রেপ্তার ও আটক রাখার সুরক্ষা, আইনের সমতা, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা৷

বাংলাদেশে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের প্রচেষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  ধর্মীয় অনুভূতি, রাজনীতি, অপরাধ, জনস্বাস্থ্য এবং বিনোদনকে লক্ষ্য করে হয়ে থাকে৷ মূলত চারটি গ্রুপ আছে, যারা ভুয়া খবর ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত৷ এগুলো হলো: বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকেরা, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকেরা, ধর্মীয় ডানপন্থি জনগোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাভাবিত ব্যক্তিরা৷ এসব ভুল তথ্য যাচাই করার অবশ্য সুযোগ রয়েছে৷

কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু সরকারি আইন-নীতি ও উদ্যোগের মধ্য দিয়ে অপ্রচার ববন্ধের নামে নামে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার নতুন নতুন উপায় চালু হয়েছে৷ বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সংবাদ সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ এতে মাধ্যমে জানা যায়, ‘বিদেশি বিশেষজ্ঞরা’ দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে শত শত মতামত কলাম বা নিবন্ধ লিখেছেন বর্তমান সরকারের প্রশংসা করে৷ যেসব বিশেষজ্ঞের নাম এসেছে, তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই, নিবন্ধগুলোতে এই সব লেখকের পরিচয়ে বলা হয়, দুনিয়ার অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত এবং যে সব প্রবন্ধ বা নিবন্ধগুলো এসেছে সেগুলোর মাঝে প্রায় ৭০০ নিবন্ধ ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা৷

সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাড‌ভো‌কেট নিপুণ রায় চৌধুরীকে উদ্দেশ করে ‘রাতের রঙলীলা দিনে আবোল তাবোল বকা’ শীর্ষক শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি কোলাজ ভিডিও প্রচার করা হয়েছে৷ এতে দাবি করা হচ্ছে, ভিডিওটির ডান অংশের মতো বাম অংশে থাকা নারীটিও নিপুণ রায় চৌধুরী৷ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় অভিনেত্রী সোহিনী সরকারের অভিনয়ের দৃশ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় বিকৃত করে অভিনেত্রীর মুখমণ্ডল পরিবর্তন করার মাধ্যমে ওই ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে৷ সম্প্রতি “হাত ভেঙ্গে দিল রুমিন ফারহানার ইন্না-লিল্লাহ” ক্যাপশনে একটি ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে৷ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেসবুকে প্রকাশিত ভিডিওটি তিন বছরের পুরনো৷ মূলত ভিডিওটি ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাগরিক টিভির ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত “বলা না বলা-তে” শীর্ষক একটি টকশো থেকে নেয়া হয়েছে৷ টকশোতে উপস্থিত অন্য বক্তার সঙ্গে বিএনপি দলীয় হুইপ ও এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বাদানুবাদ হয়৷ তবে সেখানে হাত ভাঙ্গার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ একইভাবে, বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদের নামে খোলা ওই ফেসবুক পেজেও নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য কিংবা গুজব ছড়ানো হয়েছে৷

বাংলাদেশকে মূলত করোনাকাল থেকে মত প্রকাশের অধিকার বাস্তবায়নে বেশ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে৷ বাংলাদেশের সংবিধান এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ তবে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রতিরোধে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক সময় বেশ বেগ পেতে হয়েছে এবং হচ্ছে৷ গুজব, মিথ্যা, ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ন্ত্রণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের অধিকারগুলো কতগুলো নির্দিষ্ট কারণে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে৷ তবে আইনের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞাগুলো পরিষ্কার করে বলতে হবে, একটি বৈধ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় এবং আনুপাতিক হতে হবে৷

গুজব, মিথ্যা, ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ন্ত্রণে মত প্রকাশে বাধা দেয়া, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে নিষেধাজ্ঞা, এবং মত প্রকাশ করায় নোটিশ এবং ওএসডি করবার ঘটনা ঘটেছে৷ কিছুক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ব্যক্তি, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে কুচক্রি মহল নানান কুৎসামূলক বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও প্রচার করছে এবং কর্তৃপক্ষের আইনি পদক্ষেপের শিকার হয়েছেন৷

আইনি পদক্ষেপের ক্ষেত্রে এতোদিন ধরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ এবং ৩১ ধারা ব্যবহার করা হয়েছে৷ কিন্তু ২৫ ও ৩১ ধারা বিশদ বিস্তৃত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে৷ এই বিধানগুলো সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কিত, যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা এবং সমালোচনামূলক মতামত দেয়া সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আইনি নিগ্রহ করতে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে৷

নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা, পরিপত্র এবং নির্দেশনা কতটা সংবিধানসহ অন্যান্য আইন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার নীতি মেনে করা হয়েছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় মানবাধিকার আইন অনুযায়ী প্রশ্ন করা যায়৷ কারণ, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ এর ৪ ধারায় বলা আছে “কোন তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিতে পারিবেন

আর এই আইনের ৫ ধারায় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশকারীকে ফৌজদারী বা দেওয়ানী মামলা বা বিভাগীয় মামলা, পদাবনতি, হয়রানিমূলক বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া, অন্য কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদির শিকার করা যাবে না৷ তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে৷

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর  উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলোর প্রত্যেকটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ এর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং এই আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ৷ এছাড়াও সিদ্ধান্তগুলো তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর মূলনীতিরও বিপরীত৷ আর একটি বড় সমস্যা হলো বাংলাদেশের কোনো আইনে ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’, ‘হেয়প্রতিপন্ন করা’ ইত্যাদি শব্দাবলির ব্যাখ্যা নেই, যার মাধ্যমে নাগরিকেরা বুঝতে পারবেন যে ঠিক কোন কাজগুলো করলে এসকল দোষে দুষ্ট হবে! এভাবেই আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।

ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারে বা গুজব সৃষ্টি ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যদি কেউ যুক্ত থাকেন কিংবা কারো নামে অভিযোগ থাকে, তবে আইনের চোখে তাদের বড় পরিচয় হল অভিযুক্ত, যথাযথ আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তারা অপরাধী নন৷ আর কোনো পত্রিকা যদি সে চেষ্টা করে থাকে, তবে তা মিডিয়া ট্রায়াল৷ কেননা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬-এর অনুচ্ছেদ ১৯ এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ দূত ফ্রাংক লা রু-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে হলে তিনটি মূলনীতি অনুরসণ করতে হবে৷ এগুলো হলো:

১. স্বাধীনতাকে আসলেই খর্ব করা দরকার কিনা, ২. স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সুলিখিত আইনি কাঠামো অনুসরণ করা এবং ৩. স্বাধীনতা খর্ব করতে যেয়ে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করা৷

এখানে এটা স্পষ্ট নয় যে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো কিংবা গুজব শনাক্তকরণ কী শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করবে, নাকি এখানে বিচার বিভাগকে সংশ্লিষ্ট করে একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই শনাক্তকরণের কাজটি করা হবে৷

ফলে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো শনাক্ত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বিচারিক আদালতের পর্যবেক্ষণ বা তদারকি না থাকে, অনেক সময় বিভিন্ন মানবাধিকার হরণের অভিযোগ উঠে থাকে৷ একই সঙ্গে, জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয় যে স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর এটি এক প্রকার বাধা কিনা৷

উপরন্ত, জাতিসংঘ সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা, সভা সমাবেশ এবং সংগঠন করার স্বাধীনতাকে সম্মান ও সমুন্নত রাখতে আহ্বান জানিয়েছে৷ একই সঙ্গে সাইবার পুলিশিং এবং ক্রমবর্ধমান নজরদারি কার্যক্রম সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়েছে৷ সুতরাং, মিথ্যা কিংবা ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য কিংবা গুজব রোধে সরকার অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার যে কোনও প্রয়াস থামামে হবে৷ একইসঙ্গে সরকারকে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় মানবাধিকার আইনের নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে৷ বৈধ এবং সঠিক বক্তব্যকে অবরুদ্ধ করা উচিত হবে না৷

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

এস. এ টিভি সমন্ধে

SATV (South Asian Television) is a privately owned ‘infotainment’ television channel in Bangladesh. It is the first ever station in Bangladesh using both HD and 3G Technology. The channel is owned by SA Group, one of the largest transportation and real estate groups of the country. SATV is the first channel to bring ‘Idol’ franchise in Bangladesh through Bangladeshi Idol.

যোগাযোগ

বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬,
গুলশান-১, ঢাকা-১২১২,
বাংলাদেশ।
ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০
ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪
ই-মেইল: info@satv.tv
ওয়েবসাইট: www.satv.tv

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩। বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ। ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০, ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

গুজব থামাতে মত প্রকাশে বাধা দেয়া যাবে না

আপডেট সময় : ১১:৩৮:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গণতান্ত্রিক নির্বাচন একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া, যা নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে৷

বিশ্বের অনেক জায়গার মত বাংলাদেশেও এই গণতান্ত্রিক নীতিগুলোকে মিথ্যা, অতিরঞ্জিত বা পরস্পরবিরোধী তথ্যের কৌশলগত অবস্থান এবং প্রচার গণতান্ত্রিক নির্বাচনী পরিবেশেকে দুর্বল করবার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়৷

ইচ্ছাকৃত প্রতিবেদন কিংবা প্রবন্ধের মধ্যে ঝাপসা সত্য এবং কল্পকাহিনী ভোটারদের বিভ্রান্তি বাড়ায় এবং সত্যভিত্তিক রাজনৈতিক বিতর্ককে অবমূল্যায়ন করে৷ একইসঙ্গে গুজব, শ্রবণ এবং সাইবার পরিসরে হয়রানি এবং তথ্যের কারসাজি অনেকসময় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে ব্যবহার করা হয়৷ এছাড়াও, সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ নষ্ট করে সামাজিক বিভেদ তৈরি করে দেয় এবং নারী, শিশু ও প্রান্তিক মানুষদের আরো প্রান্তিক করে দেয়৷

শেষ পর্যন্ত ভোটার ও নাগরিকদের ভোটের প্রতি আগ্রহ কমে আসে এবং নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত সংস্থাগুলোর ওপর আস্থা কমে আসে৷ এতে রাজনৈতিক পরিবেশ যেমন অস্থিতিশীল হয়, নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতার আশঙ্কাও বেড়ে যায়৷ এই সুযোগে কর্তৃত্ববাদীদের সামনে আসার সুযোগ যেমন বেড়ে যায়, তেমনি গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়৷

ভুল এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কৌশলটি বড় পরিসরে আলোচনায় আসে ২০১৬ সালে৷ ওই বছর ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করায় আন্তর্জাতিক পরিসরে মনোযোগ আকর্ষণ করে রাশিয়া৷ একইভাবে, রাশিয়া বা চীনের নির্বাচনেও এমন ঘটনা দেখা গেছে৷

নির্বাচনের সময় ‘বিভ্রান্তি’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ কিছু দেশ ভুল তথ্যের প্রেক্ষাপটে ভুয়া খবর ছড়িয়ে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে প্রভাবিত করছে৷ অন্যান্য দেশের মত সামাজিক যোগাযোগ এবং অন্য যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো বাংলাদেশে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

ভুল তথ্য (misinformation), বিভ্রান্তিমূলক তথ্য (Disinformation) এবং ম্যালিনফর্মেশন (malinformation) মিলিয়ে এমডিএম (MDM)৷ বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ এই এমডিএম-এর মাধ্যমে প্রাভাবিত হচ্ছে৷ মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এবং অ্যামপ্লিফিকেশন নেটওয়ার্কের মতো নতুন প্রযুক্তি প্রকৃত তথ্যকে বিকৃত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে৷

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য, যেমন ডিপফেকস ছড়িয়ে দিতে পারে৷ ডিপফেকগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ছবি, অডিও এবং ভিডিওকে বোঝানো হয়, যা আসল চিত্র, অডিও বা ভিডিওর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়৷ অন্যদিকে, ভুল তথ্য বলতে এমন তথ্য বোঝায় যা ক্ষতি করার উদ্দেশে নয়৷ বিভ্রান্তিকর তথ্য বলতে মিথ্যা তথ্যকে বোঝায় যেগুলো  ক্ষতির কারণ বা মানুষ, সংস্থা এবং দেশগুলোকে ভুল পথে পরিচালিত করার উদ্দেশে করা হয়৷ ম্যালিনফরমেশন এমন তথ্যকে বোঝায় যা সত্য থেকে উদ্ভূত হয়, কিন্তু প্রায়ই অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়৷

২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সামাজিক মিডিয়া গুজব বিশ্লেষণ করেছেন মো. সাইদ আল-জামান৷ সেখানসে গুজবের সাতটি বিষয়ভিত্তিক বিভাগ তুলে ধরা হয়৷ এগুলোর মধ্যে প্রথমে আছে রাজনৈতিক (৩৪.৩%), তারপরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ( ১৬.০%), অপরাধ ও মানবাধিকার (১১.০০%) এবং ধর্মীয় (১১.০%)৷

নির্বাচন, রাজনৈতিক দল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যা, প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা, উন্নয়নপ্রকল্প এবং রাজনৈতিক নেতারা হলেন রাজনৈতিক গুজবের সাধারণ বিষয়৷ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা ও মৃত্যু, সংক্রমণ, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং অ্যাকাডেমিক দুর্নীতি ও অসততা সবই স্বাস্থ্য ও শিক্ষার গুজবের সাধারণ বিষয়৷ অপরাধ-সম্পর্কিত গুজবগুলো প্রায়ই নরহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, জাতিগত নির্মূল এবং সহিংসতাকে কেন্দ্র করে৷ ধর্মীয় গুজবগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বক্তৃতা, ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা, ধর্মীয় নিয়ম ও প্রবিধান এবং ঐতিহাসিক ধর্মীয় ঘটনাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে৷ এটি লক্ষণীয় যে ধর্মীয় এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক গুজবগুলো সব গুজবের ২০.৯৯ শতাংশের জন্য দায়ী, সম্ভবত রাজনৈতিক গুজবের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ৷ এর থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে ধর্ম সংক্রান্ত গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি সহজ লক্ষ্য৷

এই কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, ভুল এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বাংলাদেশের কিছু মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারকে প্রভাবিত করে৷ এগুলোর মধ্যে মধ্যে রয়েছে মত প্রকাশ, সভা, সমাবেশের স্বাধীনতা, জীবনের অধিকার, বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে সুরক্ষা, গ্রেপ্তার ও আটক রাখার সুরক্ষা, আইনের সমতা, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা৷

বাংলাদেশে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের প্রচেষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  ধর্মীয় অনুভূতি, রাজনীতি, অপরাধ, জনস্বাস্থ্য এবং বিনোদনকে লক্ষ্য করে হয়ে থাকে৷ মূলত চারটি গ্রুপ আছে, যারা ভুয়া খবর ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত৷ এগুলো হলো: বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকেরা, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকেরা, ধর্মীয় ডানপন্থি জনগোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাভাবিত ব্যক্তিরা৷ এসব ভুল তথ্য যাচাই করার অবশ্য সুযোগ রয়েছে৷

কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু সরকারি আইন-নীতি ও উদ্যোগের মধ্য দিয়ে অপ্রচার ববন্ধের নামে নামে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার নতুন নতুন উপায় চালু হয়েছে৷ বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সংবাদ সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ এতে মাধ্যমে জানা যায়, ‘বিদেশি বিশেষজ্ঞরা’ দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে শত শত মতামত কলাম বা নিবন্ধ লিখেছেন বর্তমান সরকারের প্রশংসা করে৷ যেসব বিশেষজ্ঞের নাম এসেছে, তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই, নিবন্ধগুলোতে এই সব লেখকের পরিচয়ে বলা হয়, দুনিয়ার অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত এবং যে সব প্রবন্ধ বা নিবন্ধগুলো এসেছে সেগুলোর মাঝে প্রায় ৭০০ নিবন্ধ ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা৷

সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাড‌ভো‌কেট নিপুণ রায় চৌধুরীকে উদ্দেশ করে ‘রাতের রঙলীলা দিনে আবোল তাবোল বকা’ শীর্ষক শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি কোলাজ ভিডিও প্রচার করা হয়েছে৷ এতে দাবি করা হচ্ছে, ভিডিওটির ডান অংশের মতো বাম অংশে থাকা নারীটিও নিপুণ রায় চৌধুরী৷ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় অভিনেত্রী সোহিনী সরকারের অভিনয়ের দৃশ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় বিকৃত করে অভিনেত্রীর মুখমণ্ডল পরিবর্তন করার মাধ্যমে ওই ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে৷ সম্প্রতি “হাত ভেঙ্গে দিল রুমিন ফারহানার ইন্না-লিল্লাহ” ক্যাপশনে একটি ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে৷ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেসবুকে প্রকাশিত ভিডিওটি তিন বছরের পুরনো৷ মূলত ভিডিওটি ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাগরিক টিভির ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত “বলা না বলা-তে” শীর্ষক একটি টকশো থেকে নেয়া হয়েছে৷ টকশোতে উপস্থিত অন্য বক্তার সঙ্গে বিএনপি দলীয় হুইপ ও এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বাদানুবাদ হয়৷ তবে সেখানে হাত ভাঙ্গার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ একইভাবে, বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদের নামে খোলা ওই ফেসবুক পেজেও নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য কিংবা গুজব ছড়ানো হয়েছে৷

বাংলাদেশকে মূলত করোনাকাল থেকে মত প্রকাশের অধিকার বাস্তবায়নে বেশ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে৷ বাংলাদেশের সংবিধান এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ তবে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রতিরোধে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক সময় বেশ বেগ পেতে হয়েছে এবং হচ্ছে৷ গুজব, মিথ্যা, ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ন্ত্রণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের অধিকারগুলো কতগুলো নির্দিষ্ট কারণে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে৷ তবে আইনের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞাগুলো পরিষ্কার করে বলতে হবে, একটি বৈধ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় এবং আনুপাতিক হতে হবে৷

গুজব, মিথ্যা, ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ন্ত্রণে মত প্রকাশে বাধা দেয়া, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে নিষেধাজ্ঞা, এবং মত প্রকাশ করায় নোটিশ এবং ওএসডি করবার ঘটনা ঘটেছে৷ কিছুক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ব্যক্তি, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে কুচক্রি মহল নানান কুৎসামূলক বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও প্রচার করছে এবং কর্তৃপক্ষের আইনি পদক্ষেপের শিকার হয়েছেন৷

আইনি পদক্ষেপের ক্ষেত্রে এতোদিন ধরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ এবং ৩১ ধারা ব্যবহার করা হয়েছে৷ কিন্তু ২৫ ও ৩১ ধারা বিশদ বিস্তৃত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে৷ এই বিধানগুলো সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কিত, যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা এবং সমালোচনামূলক মতামত দেয়া সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আইনি নিগ্রহ করতে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে৷

নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা, পরিপত্র এবং নির্দেশনা কতটা সংবিধানসহ অন্যান্য আইন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার নীতি মেনে করা হয়েছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় মানবাধিকার আইন অনুযায়ী প্রশ্ন করা যায়৷ কারণ, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ এর ৪ ধারায় বলা আছে “কোন তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিতে পারিবেন

আর এই আইনের ৫ ধারায় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশকারীকে ফৌজদারী বা দেওয়ানী মামলা বা বিভাগীয় মামলা, পদাবনতি, হয়রানিমূলক বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া, অন্য কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদির শিকার করা যাবে না৷ তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে৷

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর  উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলোর প্রত্যেকটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ এর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং এই আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ৷ এছাড়াও সিদ্ধান্তগুলো তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর মূলনীতিরও বিপরীত৷ আর একটি বড় সমস্যা হলো বাংলাদেশের কোনো আইনে ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’, ‘হেয়প্রতিপন্ন করা’ ইত্যাদি শব্দাবলির ব্যাখ্যা নেই, যার মাধ্যমে নাগরিকেরা বুঝতে পারবেন যে ঠিক কোন কাজগুলো করলে এসকল দোষে দুষ্ট হবে! এভাবেই আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।

ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারে বা গুজব সৃষ্টি ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যদি কেউ যুক্ত থাকেন কিংবা কারো নামে অভিযোগ থাকে, তবে আইনের চোখে তাদের বড় পরিচয় হল অভিযুক্ত, যথাযথ আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তারা অপরাধী নন৷ আর কোনো পত্রিকা যদি সে চেষ্টা করে থাকে, তবে তা মিডিয়া ট্রায়াল৷ কেননা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬-এর অনুচ্ছেদ ১৯ এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ দূত ফ্রাংক লা রু-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে হলে তিনটি মূলনীতি অনুরসণ করতে হবে৷ এগুলো হলো:

১. স্বাধীনতাকে আসলেই খর্ব করা দরকার কিনা, ২. স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সুলিখিত আইনি কাঠামো অনুসরণ করা এবং ৩. স্বাধীনতা খর্ব করতে যেয়ে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করা৷

এখানে এটা স্পষ্ট নয় যে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো কিংবা গুজব শনাক্তকরণ কী শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করবে, নাকি এখানে বিচার বিভাগকে সংশ্লিষ্ট করে একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই শনাক্তকরণের কাজটি করা হবে৷

ফলে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো শনাক্ত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বিচারিক আদালতের পর্যবেক্ষণ বা তদারকি না থাকে, অনেক সময় বিভিন্ন মানবাধিকার হরণের অভিযোগ উঠে থাকে৷ একই সঙ্গে, জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয় যে স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর এটি এক প্রকার বাধা কিনা৷

উপরন্ত, জাতিসংঘ সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা, সভা সমাবেশ এবং সংগঠন করার স্বাধীনতাকে সম্মান ও সমুন্নত রাখতে আহ্বান জানিয়েছে৷ একই সঙ্গে সাইবার পুলিশিং এবং ক্রমবর্ধমান নজরদারি কার্যক্রম সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়েছে৷ সুতরাং, মিথ্যা কিংবা ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য কিংবা গুজব রোধে সরকার অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার যে কোনও প্রয়াস থামামে হবে৷ একইসঙ্গে সরকারকে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় মানবাধিকার আইনের নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে৷ বৈধ এবং সঠিক বক্তব্যকে অবরুদ্ধ করা উচিত হবে না৷

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ