০৫:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে সাক্ষরতার হারের পরিসংখ্যান ও ‘মাঠ’ পর্যায়

এস. এ টিভি
  • আপডেট সময় : ০১:২২:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ১৬১২ বার পড়া হয়েছে
এস. এ টিভি সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাংলাদেশ দৃশ্যত বেশ সফল হলেও সাফল্যের মাত্রা এবং মান সন্দেহাতীত নয়৷

লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলা সদরে বেশ কিছু বেদে পরিবারের বসবাস৷তাদের বড় একটা অংশ প্রায় কখনোই শিক্ষার আলো পায়নি৷তবে অল্প কিছুদিন আগে এসব পরিবারের শিশুরা স্কুলে যেতে শুরু করেছে৷জীবিকার তাগিদে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েন৷শিশুরা স্কুলে গেল কি গেল না সেই খোঁজ রাখার সুযোগ নেই৷বিষয়টি লক্ষ্য করে স্থানীয় যুবক ইমাম হোসেন স্বপন তাদের শিক্ষার আলো দিতে এগিয়ে আসেন৷এভাবেই ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সংশপ্তক অ্যাসোসিয়েশন।

এই সংগঠনের উদ্যোগে এখন দুটি স্কুল পরিচালিত হয়৷এর একটি প্রচেষ্টা পাঠশালা, যাতে মূলত বেদে শিশুরা পড়াশোনা করে, অন্যটি বয়স্ক বিদ্যা নিকেতন, সেখানে পড়াশোনা করেন বড়রা, মূলত নারীরা, যারা সারা দিন গ্রামে গ্রামে নানা পণ্য ফেরি করে বেড়ান অথবা সাপের খেলা দেখান৷প্রায় ২৭ জন শিক্ষক স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে বেদে নারী ও শিশুদের শিক্ষার আলো দেন৷শিশুদের পাঠদানের কাজটি হয় বিকেলে, বয়স্কদের নারীদের সন্ধ্যায়।

যাযাবর এই জনগোষ্ঠী কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় খুব বেশি দিন থাকে না৷এসব পরিবারের শিশুদের তাই বেশি দিন এক সাথে স্কুলে ধরে রাখা যায় না৷বয়স্কদের পড়াশোনায় আকৃষ্ট করতে সংশপ্তক তাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে, যাতে এসব নারী অক্ষরজ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি স্থায়ী পেশায় মন দিতে পারেন এবং পরিবারের শিশুদের নিয়মিত স্কুলে পাঠাতে পারেন৷”আমার এই পরিকল্পনা এবং উদ্যোগগুলো পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই আস্তে আস্তে৷আমি চাই সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক৷আমরা আশেপাশের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই”- টেলিফোনে লক্ষীপুর থেকে বলছিলেন স্বপন।

আশেপাশে সবার মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এ ধরনের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দেশের সব অঞ্চলে কম-বেশি আছে৷তাতে সুবিধাবঞ্চিত একটা অংশ কিছুটা হলেও আলোর দিশা পাচ্ছে৷তবে এসব উদ্যোগ যে এখনো অপর্যাপ্ত তা সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে৷গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া এক হিসেবে দেখা গেছে, চা বাগান এলাকায় শিশুদের স্কুলের গড় সময়কাল ২.৯ বছর, যেখানে জাতীয় গড় ৬.২ বছর৷এসব চা-বাগান এলাকার স্কুল শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় কোনো সুবিধা পাচ্ছে না এবং মোট ৫.৪ শতাংশ স্কুলগামী শিশু কোভিড-১৯ এর পরে স্কুলে ফিরে আসেনি।

নানা বৈষম্য এবং দারিদ্রের কারণে শিক্ষার যে সার্বজনীন লক্ষ্য তা এখনো দূরঅস্ত৷সম্প্রতি প্রকাশিত প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপ- ২০২৩ এ-ও এর প্রতিফলন দেখা গেছে৷এই জরিপ অনুসারে ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সের ২৭.০৩ ভাগ শিশু এখনো কোনো ধরনের প্রায়োগিক শিক্ষা পায়নি, যদিও দেশে অনেকদিন ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক৷এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস।

গত বছর পরিচালিত আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ৷তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপ- ২০২৩-এ এই হার কিছুটা কম পাওয়া গেছে৷গত ১৮ জুলাই প্রকাশিত এই জরিপে দেখা যাচ্ছে দেশে সাক্ষরতার হার এই মুহূর্তে ৭৩.৯৫৷প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপটি করা হয়েছে মূলত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪-এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য৷লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘের এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে কিন্তু সাক্ষরতা সরাসরি সম্পর্কিত নয়৷বরং এই লক্ষমাত্রায় বলা হয়েছে, মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা, জীবনব্যাপী শিক্ষার কথা৷এরই প্রেক্ষপটে সাক্ষরতার পাশাপাশি প্রায়োগিক সাক্ষরতার হারও যাচাই করা হয়েছে।

এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, পড়তে পারেন, লিখতে পারেন, বুঝতে পারেন ও গণনা করতে পারেন- এমন প্রায়োগিক সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষের হার ৬২ দশমিক ৯২৷এই জরিপেরই আরো একটি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে ৫০ শতাংশও নয়৷জরিপটিতে দেখা গেছে, দেশে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয় এমন মানুষ ২৬.০৫%৷আংশিক সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ১১.০৩ শতাংশ৷প্রাথমিক পর্যায়ের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ১৯.৩০% আর উন্নত পর্যায়ের সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ৪৩.৬২ শতাংশ৷সাধারণভাবে এই শেষোক্ত জনগোষ্ঠীকেই বলা যায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।

প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপটি ২০১১ সালেও করা হয়েছিল৷তাতে সেই সময় দেখা গেছে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ‘উন্নত স্তরের’ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ৪০.৩ শতাংশ৷সেই জরিপে সামগ্রিকভাবে সাক্ষরতার হার পাওয়া গিয়েছিল ৫৩.৩ শতাংশ৷জরিপ দুটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত এক যুগে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ২০ শতাংশ বাড়লেও ‘প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী’র সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি৷উন্নত পর্যায়ের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বলতে জরিপ দুটিতে বোঝানো হয়েছে সাবলীলভাবে পড়তে ও লিখতে পারার দক্ষতা, চারটি গাণিতিক নিয়মের দক্ষতা এবং দৈনন্দিন জীবনে দক্ষতা ব্যবহার করার ক্ষমতা।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিতের হার নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড এখনো বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত নয়৷সাক্ষরতা অর্জনই মূলত সব দেশের লক্ষ্য৷এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে মানদণ্ড ব্যবহার করে সেটাকেও ত্রুটিপূর্ণ বলছেন কেউ কেউ৷ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ মনে করেন, আমাদের দেশে তৃতীয় শ্রেনি পর্যন্ত যারা স্কুলে যায় এবং বিভিন্ন সাক্ষরতা কর্মসূচীতে যারা অংশ নেয়, তাদেরই মূলত মনে করা হয় সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ৷এক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত প্রায়ই বাড়িয়ে ধরা হয়, যা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না৷স্বাধীন কোনো সংস্থা দিয়ে যাচাই করা হলে দেখা যাবে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা আরো কম।”

শিক্ষা ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অভাব এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারেরও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন প্রবীণ এই অধ্যাপক৷এই অঙ্গীকারের ঘাটতির কারণে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে৷একটা সময়ে কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিজনের জন্য একজনকে অক্ষরজ্ঞান দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল৷কিন্তু উদ্যোগটি তেমন ভালো ফল বয়ে আনেনি, কারণ, অনেকেই সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষকে নিরক্ষর সাজিয়ে বাড়তি নম্বর পাওয়া চেষ্টা করেছে৷বিষয়টা হাসাহাসির পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া পর উদ্যোগটিই বাদ দেয়া হয়৷

এক্ষেত্রে আরো একটি ভালো উদ্যোগ স্কুল ফিডিং কর্মসূচি৷স্কুলে খাবার থাকা কেবল একটি শিশুকে শিক্ষা অর্জনের উৎসাহিত করে না, এটি তাদের পুষ্টি দেয় এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়৷যুগান্তকারী এই উদ্যোগকেও হাস্যকর করা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কীভাবে খিচুড়ি রান্না করা হয়, পরিবেশন করা হয় এটা দেখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের উদ্যোগে৷যদিও ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই ধরনের সফর আর হয়েছে বলে জানা যায়নি৷২০২৩ সালের মধ্যে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মিড ডে মিল দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও তা এখনও ব্যাপক আকারে চালু করা যায়নি।

রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে অধ্যাপক মনজুর সবচেয়ে বড় ঘাটতিটি দেখছেন ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন না হওয়ার মাঝে৷”শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য এত বছরেও সামগ্রিক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি৷খণ্ডিতভাবে কেবল কিছু অংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷কোনো খাতওয়ারি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি।”

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সরকারি-বেসরকারি যেসব উদ্যোগ তার কোনোটিকেই যথেষ্ট মনে করেন না৷ “আমি মনে করি প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ খুবই কম৷এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও মানুষের আগ্রহ থাকে না৷মাধ্যমিক যে স্কুল থাকে সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা হয়, এ জন্য যে আলাদা স্কুল দরকার হয়, সেগুলোর ব্যাপারে আগ্রহ সরকারের দিক থেকেও দেখা যায় না, সামাজিকভাবেও দেখা যায় না,’’ বলেছেন তিনি৷

তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সঠিক পথেই আছেন৷ ‘‘আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি যারা ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সি তাদের জন্য উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে৷ যারা এর বাইরে চলে যায়, লাইফ লং, তাদের জন্যও কর্মসূচি আছে৷ সুতরাং, আমরা সমন্বিতভাবেই কাজ করছি, যাতে কেউ সাক্ষরতা কর্মসূচি থেকে বাদ না পড়ে,’’ বলেছেন প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব ফরিদ আহাম্মদ।

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

এস. এ টিভি সমন্ধে

SATV (South Asian Television) is a privately owned ‘infotainment’ television channel in Bangladesh. It is the first ever station in Bangladesh using both HD and 3G Technology. The channel is owned by SA Group, one of the largest transportation and real estate groups of the country. SATV is the first channel to bring ‘Idol’ franchise in Bangladesh through Bangladeshi Idol.

যোগাযোগ

বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬,
গুলশান-১, ঢাকা-১২১২,
বাংলাদেশ।
ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০
ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪
ই-মেইল: info@satv.tv
ওয়েবসাইট: www.satv.tv

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩। বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ। ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০, ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

বাংলাদেশে সাক্ষরতার হারের পরিসংখ্যান ও ‘মাঠ’ পর্যায়

আপডেট সময় : ০১:২২:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাংলাদেশ দৃশ্যত বেশ সফল হলেও সাফল্যের মাত্রা এবং মান সন্দেহাতীত নয়৷

লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলা সদরে বেশ কিছু বেদে পরিবারের বসবাস৷তাদের বড় একটা অংশ প্রায় কখনোই শিক্ষার আলো পায়নি৷তবে অল্প কিছুদিন আগে এসব পরিবারের শিশুরা স্কুলে যেতে শুরু করেছে৷জীবিকার তাগিদে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েন৷শিশুরা স্কুলে গেল কি গেল না সেই খোঁজ রাখার সুযোগ নেই৷বিষয়টি লক্ষ্য করে স্থানীয় যুবক ইমাম হোসেন স্বপন তাদের শিক্ষার আলো দিতে এগিয়ে আসেন৷এভাবেই ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সংশপ্তক অ্যাসোসিয়েশন।

এই সংগঠনের উদ্যোগে এখন দুটি স্কুল পরিচালিত হয়৷এর একটি প্রচেষ্টা পাঠশালা, যাতে মূলত বেদে শিশুরা পড়াশোনা করে, অন্যটি বয়স্ক বিদ্যা নিকেতন, সেখানে পড়াশোনা করেন বড়রা, মূলত নারীরা, যারা সারা দিন গ্রামে গ্রামে নানা পণ্য ফেরি করে বেড়ান অথবা সাপের খেলা দেখান৷প্রায় ২৭ জন শিক্ষক স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে বেদে নারী ও শিশুদের শিক্ষার আলো দেন৷শিশুদের পাঠদানের কাজটি হয় বিকেলে, বয়স্কদের নারীদের সন্ধ্যায়।

যাযাবর এই জনগোষ্ঠী কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় খুব বেশি দিন থাকে না৷এসব পরিবারের শিশুদের তাই বেশি দিন এক সাথে স্কুলে ধরে রাখা যায় না৷বয়স্কদের পড়াশোনায় আকৃষ্ট করতে সংশপ্তক তাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে, যাতে এসব নারী অক্ষরজ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি স্থায়ী পেশায় মন দিতে পারেন এবং পরিবারের শিশুদের নিয়মিত স্কুলে পাঠাতে পারেন৷”আমার এই পরিকল্পনা এবং উদ্যোগগুলো পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই আস্তে আস্তে৷আমি চাই সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক৷আমরা আশেপাশের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই”- টেলিফোনে লক্ষীপুর থেকে বলছিলেন স্বপন।

আশেপাশে সবার মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এ ধরনের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দেশের সব অঞ্চলে কম-বেশি আছে৷তাতে সুবিধাবঞ্চিত একটা অংশ কিছুটা হলেও আলোর দিশা পাচ্ছে৷তবে এসব উদ্যোগ যে এখনো অপর্যাপ্ত তা সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে৷গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া এক হিসেবে দেখা গেছে, চা বাগান এলাকায় শিশুদের স্কুলের গড় সময়কাল ২.৯ বছর, যেখানে জাতীয় গড় ৬.২ বছর৷এসব চা-বাগান এলাকার স্কুল শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় কোনো সুবিধা পাচ্ছে না এবং মোট ৫.৪ শতাংশ স্কুলগামী শিশু কোভিড-১৯ এর পরে স্কুলে ফিরে আসেনি।

নানা বৈষম্য এবং দারিদ্রের কারণে শিক্ষার যে সার্বজনীন লক্ষ্য তা এখনো দূরঅস্ত৷সম্প্রতি প্রকাশিত প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপ- ২০২৩ এ-ও এর প্রতিফলন দেখা গেছে৷এই জরিপ অনুসারে ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সের ২৭.০৩ ভাগ শিশু এখনো কোনো ধরনের প্রায়োগিক শিক্ষা পায়নি, যদিও দেশে অনেকদিন ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক৷এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস।

গত বছর পরিচালিত আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ৷তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপ- ২০২৩-এ এই হার কিছুটা কম পাওয়া গেছে৷গত ১৮ জুলাই প্রকাশিত এই জরিপে দেখা যাচ্ছে দেশে সাক্ষরতার হার এই মুহূর্তে ৭৩.৯৫৷প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপটি করা হয়েছে মূলত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪-এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য৷লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘের এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে কিন্তু সাক্ষরতা সরাসরি সম্পর্কিত নয়৷বরং এই লক্ষমাত্রায় বলা হয়েছে, মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা, জীবনব্যাপী শিক্ষার কথা৷এরই প্রেক্ষপটে সাক্ষরতার পাশাপাশি প্রায়োগিক সাক্ষরতার হারও যাচাই করা হয়েছে।

এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, পড়তে পারেন, লিখতে পারেন, বুঝতে পারেন ও গণনা করতে পারেন- এমন প্রায়োগিক সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষের হার ৬২ দশমিক ৯২৷এই জরিপেরই আরো একটি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে ৫০ শতাংশও নয়৷জরিপটিতে দেখা গেছে, দেশে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয় এমন মানুষ ২৬.০৫%৷আংশিক সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ১১.০৩ শতাংশ৷প্রাথমিক পর্যায়ের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ১৯.৩০% আর উন্নত পর্যায়ের সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ৪৩.৬২ শতাংশ৷সাধারণভাবে এই শেষোক্ত জনগোষ্ঠীকেই বলা যায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।

প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপটি ২০১১ সালেও করা হয়েছিল৷তাতে সেই সময় দেখা গেছে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ‘উন্নত স্তরের’ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ৪০.৩ শতাংশ৷সেই জরিপে সামগ্রিকভাবে সাক্ষরতার হার পাওয়া গিয়েছিল ৫৩.৩ শতাংশ৷জরিপ দুটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত এক যুগে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ২০ শতাংশ বাড়লেও ‘প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী’র সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি৷উন্নত পর্যায়ের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বলতে জরিপ দুটিতে বোঝানো হয়েছে সাবলীলভাবে পড়তে ও লিখতে পারার দক্ষতা, চারটি গাণিতিক নিয়মের দক্ষতা এবং দৈনন্দিন জীবনে দক্ষতা ব্যবহার করার ক্ষমতা।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিতের হার নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড এখনো বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত নয়৷সাক্ষরতা অর্জনই মূলত সব দেশের লক্ষ্য৷এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে মানদণ্ড ব্যবহার করে সেটাকেও ত্রুটিপূর্ণ বলছেন কেউ কেউ৷ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ মনে করেন, আমাদের দেশে তৃতীয় শ্রেনি পর্যন্ত যারা স্কুলে যায় এবং বিভিন্ন সাক্ষরতা কর্মসূচীতে যারা অংশ নেয়, তাদেরই মূলত মনে করা হয় সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ৷এক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত প্রায়ই বাড়িয়ে ধরা হয়, যা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না৷স্বাধীন কোনো সংস্থা দিয়ে যাচাই করা হলে দেখা যাবে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা আরো কম।”

শিক্ষা ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অভাব এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারেরও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন প্রবীণ এই অধ্যাপক৷এই অঙ্গীকারের ঘাটতির কারণে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে৷একটা সময়ে কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিজনের জন্য একজনকে অক্ষরজ্ঞান দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল৷কিন্তু উদ্যোগটি তেমন ভালো ফল বয়ে আনেনি, কারণ, অনেকেই সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষকে নিরক্ষর সাজিয়ে বাড়তি নম্বর পাওয়া চেষ্টা করেছে৷বিষয়টা হাসাহাসির পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া পর উদ্যোগটিই বাদ দেয়া হয়৷

এক্ষেত্রে আরো একটি ভালো উদ্যোগ স্কুল ফিডিং কর্মসূচি৷স্কুলে খাবার থাকা কেবল একটি শিশুকে শিক্ষা অর্জনের উৎসাহিত করে না, এটি তাদের পুষ্টি দেয় এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়৷যুগান্তকারী এই উদ্যোগকেও হাস্যকর করা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কীভাবে খিচুড়ি রান্না করা হয়, পরিবেশন করা হয় এটা দেখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের উদ্যোগে৷যদিও ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই ধরনের সফর আর হয়েছে বলে জানা যায়নি৷২০২৩ সালের মধ্যে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মিড ডে মিল দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও তা এখনও ব্যাপক আকারে চালু করা যায়নি।

রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে অধ্যাপক মনজুর সবচেয়ে বড় ঘাটতিটি দেখছেন ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন না হওয়ার মাঝে৷”শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য এত বছরেও সামগ্রিক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি৷খণ্ডিতভাবে কেবল কিছু অংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷কোনো খাতওয়ারি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি।”

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সরকারি-বেসরকারি যেসব উদ্যোগ তার কোনোটিকেই যথেষ্ট মনে করেন না৷ “আমি মনে করি প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ খুবই কম৷এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও মানুষের আগ্রহ থাকে না৷মাধ্যমিক যে স্কুল থাকে সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা হয়, এ জন্য যে আলাদা স্কুল দরকার হয়, সেগুলোর ব্যাপারে আগ্রহ সরকারের দিক থেকেও দেখা যায় না, সামাজিকভাবেও দেখা যায় না,’’ বলেছেন তিনি৷

তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সঠিক পথেই আছেন৷ ‘‘আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি যারা ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সি তাদের জন্য উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে৷ যারা এর বাইরে চলে যায়, লাইফ লং, তাদের জন্যও কর্মসূচি আছে৷ সুতরাং, আমরা সমন্বিতভাবেই কাজ করছি, যাতে কেউ সাক্ষরতা কর্মসূচি থেকে বাদ না পড়ে,’’ বলেছেন প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব ফরিদ আহাম্মদ।

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ