বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম : অসীম সম্ভাবনা ও প্রতারণার এক জগত
- আপডেট সময় : ১২:২০:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ মার্চ ২০২৩
- / ১৬৫৫ বার পড়া হয়েছে
অনলাইনে প্রতারণার ধরন বদলাচ্ছে৷ টাকা ডলার করে দেয়া, লোহা সোনা করে দেয়া- এগুলো পুরোনো হয়ে গেছে, এখন এসেছে বিনিয়োগ প্রতারণা, অর্ধেক দামে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির অফারসহ নানা ধরনের প্রতারণা৷
এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যই হলো সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া৷ এইসব প্রতারণায় ফেসবুক, টিকটকের পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে ইউটিউব, ইমো৷ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ই-কমার্সের নামে অনলাইনে ই-ভ্যালিসহ আরো কিছু কাথিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরও এই ব্যবসা এখনো বন্ধ হয়নি৷ সাধারণ মানুষের পক্ষে এখন বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে যে কারা প্রতারক এবং কারা প্রতারক নন৷
গত বছর মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী সেজে অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ প্রতারিতরা লজ্জায় নিজেদের নামও প্রকাশ করছেন না৷ ওই প্রতারক চক্র ঢাকার অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বলে নিজেদের ওয়েব সাইটে মোটা বেতনে অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়োজের বিজ্ঞপ্তি দেয়৷ যারা যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সেজে বাংলাদেশি প্রতারক চক্রের সদস্যরা৷ তাদের অফিস, গাড়ি ও হাবভাব দেখে ফেঁসে যান চাকরিপ্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা৷ তাদের বেতন ধরা হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা, পদও দেয়া হয় বিশাল৷ এরপর বিদেশে বিনিয়োগের টাকা আটকে গেছে বলে কথিত প্রমাণও দেখায়৷ সাময়িক সাপোর্টের নামে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কয়েকটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা৷
একইভাবে ঢাকায় বিনিয়োগের নামে ফেসবুকে গত বছর কিছু ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে আফ্রিকা ও বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি প্রতারক চক্র৷ যারা যোগাযোগ করেন তাদের প্রত্যেককে বলা হয় যে তারাই হবেন তাদের ব্যবসার বাংলাদেশি এজেন্ট৷ আবাসন ও কৃষি খাতে তারা বিনিয়োগ করবেন৷ তাদের জমি দেখতেও বলা হয়৷ একজন বাংলাদেশে এসে প্রজেক্টের জন্য কোটি কোটি টাকা দামের জমিও দেখে যান৷ এভাবে আস্থা অর্জন করে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর আগে প্রাথমিক কাজের জন্য তাদের স্থানীয় এজেন্টকে ধার হিসেবে টাকা দিতে বলেন৷ এইভাবে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷ ভুক্তভোগীদের একজন মিজানুর রহমান জানান, ‘‘পাঁচ লাখ টাকা নেয়ার পর বুঝতে পারি তারা প্রতারক৷ থানায় অভিযোগ করার পর চক্রের সদস্য একজন আফ্রিকান নাগরিককে গ্রেপ্তারও করা হয়৷ তখন আমি বুঝতে পারি তারা এই দেশে থেকেই আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ করে৷ কিন্তু আমার টাকা উদ্ধার করতে পারিনি৷ কারণ টাকা তারা আগেই সরিয়ে ফেলেছে৷’’
ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে দামি গিফট পাঠানোর নামে টাকা হতিয়ে নেয়ার কৌশল প্রতারণার পুরোনো কৌশল৷ তারপরও মানুষ ওই প্রতারকদের খপ্পরে পড়ছেন৷ আর উত্তরাধিকার সূত্রে লাখ লাখ ডলারের মালিক হয়ে সেই টাকা বাংলাদেশে পাঠানোর প্রতারণার ফাঁদ পাতা হচ্ছে প্রতিদিনই৷ কেউ পা দিলেই ধরা৷
সম্প্রতি ফেসবুক ও ইউটিউবার প্রত্যয় হিরনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ফেসবুক ও ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরির আড়ালে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগে৷ গত তিন বছর ধরে ভারতীয় এক এজেন্টের সঙ্গে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারে চুক্তি ছিল প্রত্যয় হিরনের৷ নিষিদ্ধ জুয়ার ব্যবসা প্রচারে একেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য প্রত্যয় নিতেন প্রায় লাখ টাকা৷
আর ‘নুর কিচেন’ নামে একটি প্রতারক চক্র ফেসবুকে পেতেছে বিনিয়োগ প্রতারণার ফাঁদ৷ তারা ঢাকা মেডিক্যালে খাবার সরবরাহের কাজ পেয়েছে বলে আকর্ষণীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগ করার জন্য প্রলোভিত করে৷ কমপক্ষে তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে৷ তারা আদৌ ওই ধরনের কোনো কাজ পায়নি৷ আর প্রতিষ্ঠানটিও বাস্তবে অস্তিত্বহীন৷
অনলাইনে প্রতারণার ধরন
গেয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জানান, এখন ছোট থেকে বড় সব ধরনের প্রতারণাই হচ্ছে অনলাইনে৷ গৃহশিক্ষক দেয়া থেকে শুরু করে পাত্র-পাত্রী সবখানেই অনলাইন প্রতারণা৷ আর প্রতারকরা সময়ের সাথে কৌশলও বদলাচ্ছে৷
ডিভোসর্ড প্রবাসী পাত্রী পরিচয়ে প্রতারক চক্রের শিকার হচ্ছেন অনেকে৷ কেউ আবার অনলাইনে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ফেঁসে যাচ্ছেন৷ তিনি জানান, ‘‘ঢাকায় উচ্চবিত্তরাও এর শিকার হচ্ছেন৷ এমন কয়েকজন আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছেন যারা টাকা তো খুইয়েছেনই এখন মান ইজ্জত কীভাবে রক্ষা করবেন সেই চিন্তায় তারা কাতর৷ তারা লিখিত অভিযোগও করতে চাননা৷ শুধু প্রতারক চক্রকে থামাকে পারলেই যেন তারা বেঁচে যান৷’’
ফেসবুকে বিদেশি নারীর ছবি ব্যবহার করেও চলছে প্রতারণা৷ তাদের কেউ ইউএস আর্মি বা নেভির সদস্য বলেও পরিচয় দেন৷ সেই ধরনের ছবিও থাকে৷ ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে৷ তারপর নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়৷ কেউ আবার আছেন বিদেশি কথিত বিনিয়োগকারী৷
‘‘আর অনলাইনে জুয়া এখন ভাইরাসের মতো হয়ে গেছে৷ সর্বশান্ত হয়ে অনেকে আমাদের কাছে আসেন৷ কিন্তু এই জুয়ার মূল লোক দেশের বাইরের৷ আমরা মাঝেমধ্যে তাদের এদেশীয় এজেন্টদের ধরি৷ কিন্তু টাকা আর পাওয়া যায়না৷ চীনা একটি অ্যাপ ব্যবহার করে তরুনরা ব্যাপকভাবে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে৷ ইমো নাম্বার হ্যাক করেও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে,’’ জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা৷
আর অনলাইনে এখন মাদকের বিরাট বাজার গড়ে উঠেছে৷ এর সঙ্গে প্রধানত তরুণরা যুক্ত৷ মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ী সবাই তরুণ৷ টিকটক হৃদয়ের কথা সবাই এখন জানেন৷ সে অনলাইনে টিকটক তারকা বানানোর লোভ দেখিয়ে ভারতে অনেক নারীকে পাচার করেছে৷ টিকটক হৃদয় এখন ভারতের কারাগারে আটক আছেন৷ মশিউর রহমান বলেন, ‘‘তারপরও টিকটক প্রতারণা থামছে না৷ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেকেই৷’’
প্রতারণার সর্বশেষ সংস্করণ ইমো প্রতারণা
বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম টিম ইমো প্রতারণার একটি চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে৷তারা মেয়ে সেজে নারী কন্ঠে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ৷
সুন্দর চেহারার ছবি দিয়ে কথিত নারীর আইডি থেকে মেসেজ দেয়া হতো প্রবাসীদের৷ এরপর শুরু কথোপকথন ও ছবি আদান-প্রদান৷ সুন্দর ছবি ও মধুর কন্ঠের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সহজেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন প্রবাসীরা৷ পরে ভিডিও কলের প্রলোভনে কৌশলে প্রবাসীদের ইমো আইডি নেয়া হতো নিয়ন্ত্রণে৷ পরে ইমো নম্বর পরিবর্তন করে অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি হিস্টোরিতে গিয়ে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের নম্বর সংগ্রহ করে নানা বাহানায় হাতিয়ে নিতো হতো লাখ লাখ টাকা৷
এই প্রতারক চক্রটি প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে জায়গা-জমি কিনে ও বিলাসবহুল বাড়ি করে উন্নত জীবনযাপন করে আসছিল৷
লিমিটলেস সম্ভাবনা, লিমিটলেস প্রতারণা
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘‘এখন সব কিছুই ওপেন৷ তাই লিমিটলেস সম্ভাবনা, লিমিটলেস প্রতারণা৷’’
বিকাশ প্রতারণা এবং ইমো হ্যাকিং এখন অনলাইন প্রতারণার শীর্ষে আছে বলে জানান তিনি৷
এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি কাজ পাইয়ে দেয়া, ওয়ার্ক অর্ডার করিয়ে দেয়া, চাকরি দেয়াসহ নানা প্রতারণা চলছে৷
তার কথা, ‘‘আসলে অধিকাংশ অনলাইন প্রতারণাই হয় বেশি লাভ বা বেশি কিছু পাওয়ার লোভ দেখিয়ে৷ সবাই জানেন ব্যাংক রেট কত৷ বিনিয়োগে লাভের সম্ভাবনা কত৷ এখন এক লাখ টাকায় মাসে ১০ হাজার টাকা লাভের অফার দেয়৷ ফলে অনেকেই ফাঁদে পা দেন৷’’
তবে এইসব অপরাধের অপরাধীদের ধরা কঠিন৷ সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে গোয়েন্দারা এখন নানা ধরনের প্রযুক্তি ও ডিভাইস ব্যবহার করছে বলে জানান তিনি৷ তবে প্রতারকরাও অনেক স্মার্ট৷ তারা নতুন যত প্রযুক্তি আসে সবগুলোই ব্যবহার করতে পারে৷
আগে সাইবার ক্রাইম ও অনলাইন প্রতারণা নিয়ে মানুষ তেমন অভিযোগ করতো না৷ এখন অভিযোগ বাড়ছে৷ প্রচুর অভিযোগ আসছে৷ তবে মামলা কম৷ মানুষ ফোনে জানাচ্ছে, এসএমএস দিচ্ছে, মৌখিকভাবে অভিযোগ করে সমাধান চান৷ সেক্ষেত্রে হয়ত সমাধান করা যায় কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা সবসময় নেয়া যায় না বলে জানান তিনি৷
সচেতনতার বিকল্প নেই
সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করেন আইটি এক্সপার্ট তানভীর হাসান জোহা৷ তিনি বলেন, ‘‘অনলাইন প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সতর্ক হতে হবে৷ লোভ সামলাতে হবে৷ অনলাইনে কারো সঙ্গে পরিচয় হলে সাবধান থাকতে হবে৷ বিনিয়োগ করা বা দামি উপহার পাওয়ার আশায় কাস্টমস ডিউটির নামে লাখ লাখ টাকা দেয়ার আগে যাচাই করতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ভূমি নিয়ে, ফ্ল্যাট নিয়ে প্রতারণা ধরা এখন সহজ হয়েছে৷ কারণ ভ‚মি ব্যবস্থাপনা এখন ডিজিটাল৷ অন্যান্য ক্ষেত্রে একটু দক্ষতা এবং ডিজিটাল জ্ঞান থাকলে অনলাইনেই অনেক কিছু চেক করা সম্ভব৷ যেমন, একটি ফেসবুক আইডি বিশ্লেষণ করলেই অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং বোঝা যায়৷’’
তার কথা, ‘‘পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট অনেক আধুনিক হয়েছে৷ কিন্তু প্রতারকরা আরো এগিয়ে৷ আর প্রতারিত হলে অভিযোগ করতে হবে৷ প্রতারিত হওয়ার আগেও কোনো অফার বা প্রস্তাবের বিষয় ওই ইউনিটের পরামর্শ নেয়া যায়৷’’
আর মশিউর রহমান বলেন, ‘‘আমরা তো আইনি সহায়তার জন্য আছি৷ কিন্তু একটু সচেতনতা অনেক কাজে আসে অনলাইন প্রতারণা থেকে বাঁচতে৷ সচেতন হলে আমরা অনলাইনে ইজ্জতহানি, মানহানি ও অর্থ খোয়ানো থেকে বাঁচতে পারি৷’’
ডয়চে ভেলে