আগস্ট ১৯৭১: নিউইয়র্কে কনসার্ট, রণাঙ্গনে ‘অপারেশন জ্যাকপট’
- আপডেট সময় : ০৪:৩৫:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ১৫৩৫ বার পড়া হয়েছে
২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। এক বছর পর, অর্থাৎ, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ফিরে তাকানো শুরু করে ডয়চে ভেলে বাংলা।
গৌরব, বীরত্ব ও বেদনার সেই নয় মাসে পর্যায়ক্রমে ফিরে তাকানোর এই পর্বে থাকছে আগস্ট ১৯৭১-এর কিছু ঘটনার কথা।
দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ছিল মুক্তিকামী বাঙালি। সীমান্তের ওপারে ভারতে মানবেতর জীবনযাপন করছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া এক কোটি শরণার্থী। তাদের জন্য কিছু করা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার দোসরদের বর্বরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়তে উদ্যোগী হন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি তখন ক্যালিফোর্নিয়ায়।একটি চ্যারিটি কনসার্টের পরিকল্পনার কথা জানান তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু বিটলসের বিখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে। শুনে হ্যারিসনও রাজি হয়ে যান। হ্যারিসনের আমন্ত্রণে কনসার্টে অংশ নিতে আগ্রহী হন বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটনসহ সংগীত জগতের অনেক মহাতারকা। একাত্তরের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি চ্যারিটি-শো আয়োজন করেন রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন।
সেই কনসার্টে আল্লা রাখা খান, আকবর আলী খানের মতো উপমহাদেশীয় ধ্রুপদি সংগীতের অনেক দিকপালও ছিলেন। ওইদিন প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের সামনে জর্জ হ্যারিসন গেয়ে ওঠেন ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গানটি।
ওই কনসার্টটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব বিবেককে শুধু জাগ্রতই করেনি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের মেলবন্ধনও তৈরি করেছিল। তাছাড়া সারা বিশ্বে দাতব্য কনসার্টের ধারারও সূচনা করেছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে জোরালোভাবে কাজ করছিল মুজিবনগর সরকার। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বদূত। তিনি নিপীড়িত, মুক্তিকামী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবির সমর্থনে দেশে দেশে প্রচার অভিযান চালাতে থাকেন।
একাত্তরের ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে তাঁর নেতৃত্বেই বিশাল এক সমাবেশ হয়। ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ যোগ দেয় সেখানে।পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপির স্বাক্ষর করা একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হয় সমাবেশে।
এরপর একজন প্রস্তাব তোলেন, পুরো বিশ্ব যেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসকে বয়কট করে। কারণ, তাদের যাত্রীবাহী বিমান বেআইনিভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়। ওই সমাবেশেই লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ ঘোষণা শোনার পর সমাবেশে উপস্থিত জনতা চিৎকার করে বলে ওঠে- ‘জয় বাংলা’!
ইউরোপে মহিউদ্দিন আহমদই প্রথম পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করা বাংলাদেশি কূটনীতিক। ফলে এ খবর ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশ করে। অতঃপর ২৭ আগস্ট লন্ডনের নটিংহিল গেটের ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনে লন্ডন, তথা সারা ইউরোপে বাংলদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হয়। সেটিই এখন বাংলাদেশ সেন্টার। এছাড়া একাত্তরে তিনজন বাঙালি রাষ্ট্রদূত পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন। তারা হলেন- ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ (২১ আগস্ট, ১৯৭১); ফিলিপাইন্সের কে কে পন্নী (১৪ সেপ্টেম্বর , ১৯৭১); আর্জেন্টিনায় আবদুল মোমেন, (১১ অক্টোবর, ১৯৭১)। (তথ্যসূত্র: লন্ডন ‘৭১: মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ফ্রন্ট-মহিউদ্দিন আহমদ)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তখন বিশ্বের অনেক বিশিষ্টজনই সক্রিয় ছিলেন। ব্রিটিশ তরুণ পল কনেট ও তার স্ত্রী এলেন লন্ডনভিত্তিক ওয়ার রেজিস্টার্স ইন্টারন্যাশনালের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও অসহায় বাঙালিদের সাহায্য করতে ‘অপারেশন ওমেগা’ নামের একটি সংস্থা গড়ে তোলেন তারা। লন্ডনের ক্যামডেনে ছিল ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে তাঁদের একটি কার্যালয়। ট্রাফালগার স্কয়ারের জনসভার তাদের উত্থাপিত মূল দাবি ছিল—বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জোরালো হতে থাকে ভারতেও। ৬ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের জনসংঘ পার্টি বড় ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানায়। বিক্ষোভকারীদের ব্যানার ও ফেস্টুনে লেখা ছিল ‘Release Mujib’, ‘Down with Pak-Us conspiracy against Bangladesh’ প্রভৃতি। বাংলার মানুষের দুঃখকে মনে ধারণ করে ওইদিন তারা আওয়াজ তোলে ‘হাম সব-এক হ্যায়’। একই দাবিতে কলকাতায় ছয়টি শ্রমিক ও বামপন্থি সংগঠনের উদ্যোগে ২৯ আগস্ট ২৪ ঘণ্টা হরতাল পালিত হয়। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র- তৃতীয়, দশম, দ্বাদশ ও চতুর্দশ খণ্ড)
কোনো কোনো মানুষ কখনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকেন না। কেউ কেউ রুখে দাঁড়ান সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীতার পক্ষে দেশে দেশে প্রতিবাদ তারই সাক্ষ্য দেয়।
পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধও চলছিল তখন। আগস্টে প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘোরানোর মতো বড় একটি অপারেশন পরিচালনা করেন নৌ-কমান্ডোরা। ১৬ আগস্টের প্রথম প্রহরে দেশের দুইটি সমুদ্রবন্দর—চট্টগ্রাম ও মোংলা, এবং দুইটি নদী বন্দর-চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে (দাউদকান্দি ফেরিঘাটসহ) একযোগে একই সময়ে পরিচালিত আত্মঘাতী ওই অভিযানের নাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ওই অপারেশনে পাকিস্তান বাহিনীর ২৬টি সমরাস্ত্র ও পণ্যবাহী জাহাজ এবং গানবোট ডুবিয়ে দেওয়া হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য।
অপারেশন জ্যাকপট কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল? সেই গল্প জানতে নৌ-কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীরপ্রতীক)-এর মুখোমুখি হয়েছিলাম। চাঁদপুর নদীবন্দর অপারেশনে অংশ নেওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘ট্রেনিংয়ের পর ৩০০ জনের মধ্য থেকে ১৬০ জনকে বেছে নেয়া হয়। চট্টগ্রামের জন্য ৬০ জন, মোংলার জন্য ৬০ জন, চাঁদপুরে ২০ জন ও নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জন করে নৌ কমান্ডো গ্রুপ তৈরি করা হয়। ফ্রান্স-ফেরত সাবমেরিনার এ ডাব্লিউ আব্দুল ওহেদ চৌধুরীকে (বীরউত্তম ও বীরবিক্রম) চট্টগ্রাম, আহসান উল্লাহকে (বীরবিক্রম) মোংলায়, বদিউল আলমকে (বীরউত্তম) চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আবেদুর রহমানকে। ৯ আগস্ট চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ– এই তিনটি গ্রুপকে ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে সামরিক বিমানে আনা হয় আগরতলায়, শালবনের ভেতর নিউ ট্র্যানজিট ক্যাম্পে। ওখান থেকে বাংলাদেশে ঢুকে অপারেশন সেরে ওখানেই ফিরতে হবে। একদিন পরেই দেওয়া হয় আর্মস অ্যামুনেশন– প্রত্যেকের জন্য একটা লিমপেড মাইন, একটা কমান্ডো নাইফ, একজোড়া ফিনস, থ্রি নট থ্রিসহ কিছু অস্ত্র এবং প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একটা টু ব্যান্ডের রেডিও। রেডিও হলো যুদ্ধে সিগন্যাল পাঠানোর মাধ্যম।গানে গানে সিগন্যাল!” শাহজাহান কবির আরো বলেন, ‘‘আমরা চাঁদপুর আসি ১১ আগস্ট, উঠি রঘুনাথপুরে এক মামার বাড়িতে। অতঃপর রেডিওতে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকি।
প্রত্যেকদিন আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র ধরে রাখার কথা বলা হয়েছিল৷ বলা হয়েছিল ওটার মাধ্যমে সিগন্যাল পাওয়া যাবে। কেমন সিগন্যাল? আকাশবাণীতে সকাল ৭ বা সাড়ে ৭টায় বাজবে একটি গান– ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান।’ এ গান হলেই অপারেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর আরেকটা গান বাজবে– ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুর বাড়ি।’ এ গানটি হলেই বুঝতে হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং ওই দিন শেষে রাত বারোটার পর অবশ্যই অ্যাটাক করতে হবে।
১৩ আগস্ট সকালে বাজলো প্রথম গানটি। আমি, নুরুল্লাহ পাটওয়ারি, বদিউল আলম সঙ্গে সঙ্গে রেকি করতে বের হই। ২৪ ঘণ্টা পর, অর্থাৎ ১৪ আগস্ট চূড়ান্ত নির্দেশনার গানটি বাজার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন সেটি না বেজে বাজলো ১৫ আগস্ট সকালে। তখন আমরা অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিই।