জার্মানিতেও ডাক্তারেরা ধর্মঘট ডাকেন, তবে বিচারে বাধা দিতে নয়
- আপডেট সময় : ০৪:৫৩:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ জুলাই ২০২৩
- / ১৬৯৮ বার পড়া হয়েছে
চিকিৎসক এবং চিকিৎসা খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তরা জার্মানিতেও ধর্মঘট ডাকেন৷ এটা তাদের অধিকার৷ তবে ধর্মঘটগুলোতে কোনো একক ব্যক্তিকে রক্ষার চেয়ে সামগ্রিক নীতি পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ থাকে৷
জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা খুবই ভালো৷ সহজে আধুনিক চিকিৎসা পাওয়া যায়৷ প্রায় সব নাগরিক স্বাস্থ্যবীমার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মূল চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথাও তেমন একটা শোনা যায় না৷ সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমার মধ্যে সেবার মানে একটু তারতম্যের কথা অবশ্য শোনা যায়, কিন্তু সেটার প্রভাব সামগ্রিক চিকিৎসার উপর পড়ে না৷
তারতম্যটা একটু খোলসা করি৷ সাধারণ হিসেবে জার্মানিতে একজন চাকুরিজীবীকে তার বেতনের ১৫ শতাংশ দিতে হয় স্বাস্থ্যবীমা হিসেবে৷ অনেক ক্ষেত্রে এই অর্থ পুরোটাই বা সেটির অর্ধেক তার চাকুরিদাতা দিয়ে দিতে পারে৷ কিন্তু সরকারি যে বীমা ব্যবস্থা তাতে আপনার মাসিক বেতনের ১৫ শতাংশের মতো স্বাস্থ্যবীমা প্রতিষ্ঠানটি পাবে৷ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা কাজ করছেন না, তারাও এই বীমার অন্তর্ভুক্ত থাকবেন৷ বাড়তি কোনো পয়সা দিতে হবে না সেজন্য৷
একইভাবে বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমাও রয়েছে৷ যাদের বেতন একটু বেশি এবং যারা বয়সে নবীন তাদেরকে বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা নিতে বেশ উৎসাহিত করা হয়৷ বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমায় কিছু বাড়তি সুবিধা মেলে৷ যেমন আপনি হাসপাতালে গেলে একাই একটি কেবিনে থাকতে পারবেন, কারো সাথে শেয়ার করতে হবে না৷ কিংবা বাড়তি খাবার পাবেন, যখন ইচ্ছা তখন খাবার এনে খেতে পারবেন৷ সেজন্য বাড়তি পয়সা গুণতে হবে না৷ বিশেষায়িত চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টও দ্রুত পাবেন৷ তবে এই বীমার ক্ষেত্রে পরিবারের বেকার সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে৷ এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বীমার মাসিক কিস্তির পরিমানও বাড়তে পারে৷
জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা ভালো হওয়ার পেছনে চিকিৎসক, সেবিকাদের দক্ষতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবীমার ভালো ভূমিকা রয়েছে বলা যায়৷ অন্তত এ খাতে অর্থের অভাবের কথা তেমন একটা শোনা যায় না৷ কিন্তু তারপরও সমস্যা হয়৷ আর সেই সমস্যা সমাধানে অনেক সময় ধর্মঘটও ডাকেন স্বাস্থ্যখাত সম্পৃক্তরা৷
গত দুই দশকের সংবাদপত্র ঘেঁটে জার্মানিতে চিকিৎসক ও সেবিকাদের ধর্মঘটের কয়েকটি নজির পেলাম৷ ২০০৫ সালে জার্মানির দুই রাজ্যের ১৪০০ চিকিৎসক ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন৷ তারা তাদের বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন৷ কারণ সেসময় ইংল্যান্ডে চিকিৎসকেরা জার্মানিতে চিকিৎসকদের তুলনায় দ্বিগুণ বেতন পেতেন বলে দাবি ছিল ধর্মঘটকারীদের৷
২০০৬ সালেও জার্মানিতে একইরকম ধর্মঘট ডাকেন চিকিৎসকরা৷ সেটিতে সায় দিয়েছিলেন ২২ হাজারের মতো চিকিৎসক৷ তাদের দাবি ছিল কাজের পরিবেশ উন্নত করার এবং সামগ্রিকভাবে চিকিৎসকদের বেতন ৩০ শতাংশ বাড়ানোর৷ সেসময় এটাও বলা হয়েছিল যে অনেক চিকিৎসক জার্মানি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কারণ ইউরোপের কেন্দ্রের দেশটিতে চিকিৎসকেরা ভালো বেতন পাচ্ছেন না৷
২০১০ সালেও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করেছেন কিছু চিকিৎসক৷ শুধু চিকিৎসকেরাই নন, নার্স এবং ফার্মাসিস্টরাও নানা সময় ধর্মঘট করেছেন৷ সর্বশেষ গত মে মাসেও এরকম ধর্মঘট হয়েছে৷ তবে, সবক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসার সুযোগ যাতে অব্যাহত থাকে সেটা রক্ষা করেই ধর্মঘট পালন করা হয়েছে৷
জার্মানির স্বাস্থ্যখাতের ধর্মঘটগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে মূলত বেতন বৃদ্ধি, কাজের পরিবেশ উন্নত করা আর বাড়তি চাপ কমানোর দাবিতে আন্দোলন করেছেন এখাতের সঙ্গে সম্পৃক্তরা৷ কিন্তু কারো অপরাধ বা কোনো অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে কি ধর্মঘট ডেকেছেন তারা?
গত কয়েক দশকে রোগীকে মেরে ফেলার দায়ে একাধিক চিকিৎসক এবং সেবিকা বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন এবং সেসব ঘটনা গোটা জার্মানিতেই আলোড়নও সৃষ্টি করেছিল৷
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের বিখ্যাত চ্যারিটে হাসপাতালের একজন কার্ডিওলজিস্টকে মে মাসে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ অভিযোগ হচ্ছে ২০২১ এবং ২০২২ সালে গুরুতর অসুস্থ দুই রোগীকে কড়া ডোজের সেডেটিভ দিয়েছিলেন তিনি৷ সেই দুই রোগীই মারা গেছেন৷
পরবর্তীতে হাসপাতালের অভিযোগের ভিত্তিতে সেই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে৷
২০২১ সালে ৫২ বছর বয়সি এক নারী নার্সকে ১৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল জার্মানির একটি আদালত৷ তিনি পস্টডামের একটি সেবাকেন্দ্রে চার প্রতিবন্ধীকে হত্যা করেছিলেন৷ আরো তিনজনকে হত্যার চেষ্টা করলেও সফল হননি৷
২০১৯ সালে আরেক সেবিকাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন জার্মানির আদালত৷ ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৮৫ জন রোগীকে প্রাণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করেছিলেন তিনি৷
জার্মানিতে চিকিৎসক এবং সেবিকারা ইচ্ছাকৃতভাবে রোগীকে হত্যার এরকম অভিযোগ আরো আছে৷ অনেক ঘটনা নিয়ে তদন্ত হয়েছে এবং বিচারও হয়েছে৷ কিন্তু এরকম মানুষদের রক্ষায় দেশজুড়ে ধর্মঘট ডাকতে দেখা যায়নি৷ পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা থাকলে সেটা করার কথাও নয়৷
কথা হচ্ছে, হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই পারে৷ কিন্তু সেটা যাতে ইচ্ছাকৃতভাবে বা অবহেলায় না ঘটে সেটা নিশ্চিত করা জরুরি৷ কেউ অপরাধ করলে বিচার হতে হবে৷ জার্মানি সেটা নিশ্চিত করে৷
ডয়চে ভেলে