০৬:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

বিচার বিভাগে ‘এক পাখির দুই ডানায়’ দ্বন্দ্ব

এস. এ টিভি
  • আপডেট সময় : ০১:৪৮:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ১৫৯৭ বার পড়া হয়েছে

ছবি- সংগৃহীত

এস. এ টিভি সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বিচারক আর আইনজীবীর মধ্যে দ্বন্দ্বে বার বার বিপাকে পড়েন বিচার প্রার্থীরা৷ উভয় পক্ষেরই যেখানে ন্যায় বিচারের জন্য কাজ করার কথা, সেখানে কেন এই দ্বন্দ্ব?

বিশ্লেষকরা বলছেন চারটি কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচেছ৷ ১. অজ্ঞতা ২. মানসিকতা ৩. রাজনৈতিক প্রভাব এবং ৪. দুর্নীতি৷

তারা বলছেন, যেসব কারণে বেঞ্চ এবং বারের মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, দেশের আইনেই এর সমাধান থাকলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালত অধস্তন আদালতের এই বিষয়গুলো দেখার দায়িত্বে আছে৷ আর উচ্চ আদালতের বিষয় দেখার জন্য রাষ্ট্রপতি আছেন৷ প্রয়োজনে গঠন হতে পারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল৷ হাইকোর্টের নির্দেশনা হলো, বিচারালয়ে বিচারক এবং আইনজীবী উভয়ই সমমর্যাদার৷

ডেটলাইন ব্রাহ্মণবাড়িয়া

গত ১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে গালাগাল, তার সঙ্গে অশালীন আচরণ ও এজলাসে খারাপ ভাষা ব্যবহার করার ঘটনায় সেখানে অচলবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ আইনজীবীরাও তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং আইনজীবীদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করার অভিযোগে অব্যাহতভাবে সব আদালত বর্জন করছেন৷ অন্যদিকে আদালতের কর্মচারীরাও পাল্টা কর্মবিরতি পালন করছেন৷

আইনজীবীদের দাবি, ওই দিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে কয়েকজন আইনজীবী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকটি মামলা দাখিল করেন৷ কিন্তু দাখিলে বিলম্ব হওয়ার কারণে ওই আদালতের বিচারক মামলাগুলো গ্রহণ করেননি৷ আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামলাগুলো নেওয়ার অনুরোধ করলেও বিচারক তা শোনেননি৷ পরে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সশরীরে ওই বিচারকের এজলাসে গিয়ে মামলাটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন৷ তখন বিচারক তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন৷

এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷ এরপর হাইকোর্ট দুই দফায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ২৪ জনকে আদালতে তলব করেছেন৷ ১৭ এবং ২৩ জানুয়ারি তাদের আদালতে হাজির হতে হবে৷ এরপরও তারা আদালত বর্জন অব্যাহত রেখেছেন৷ তারা এর আগেই আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে চান৷ আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট তানজিল ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমরা জেলা জজ, ট্রাইব্যুনাল -এর বিচারক এবং ওই আদালতের নাজিরের অপসারণ চাই৷ তার আগ পর্যন্ত আদালত বর্জন অব্যাহত থাকবে৷ আমরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা করছি৷ আদালতে তারিখ অনুযায়ী হাজির হবো৷’’

নানা আদালতে দ্বন্দ্ব

গত ২৫ জুলাই এক জামিন শুনানিতে পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও বিচারিক কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় হাইকোর্টে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পান পিরোজপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খান মো. আলাউদ্দিন৷ এরপর গত সেপ্টেম্বরে খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা জজ) বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি পান৷

গত বছরের ২২ নভেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের দুর্ব্যবহার, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে আদালত বর্জন করে জেলা আইনজীবী সমিতি৷

ওই বছরের ১৯ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের আইনজীবীদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগে আদালত বর্জন করেন তারা৷একটি মামলার শুনানি চলার সময় এক বিচারকের সাথে আইনজীবীদের বাকবিতন্ডার জেরে তারা আদালত বর্জন করেন৷

একই বছরের ১৩ জুন লক্ষীপুরের আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেন৷ তারা আদালত চলাকালে আইনজীবীদের সঙ্গে এক বিচারকের অশোভন আচরণের অভিযোগ করেন৷

১৮ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা৷  তারা আদালতের একজন স্টেনোগ্রাফারের বিরুদ্ধে একজন আইনজীবীকে মারধরের অভিযোগ করেন৷

প্রতিবছরই এরম ঘটনা ঘটে চলেছে৷ কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না৷

কেন এই দ্বন্দ্ব

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক প্রভাব এই দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ কোনো বারের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রাজনৈতিক বলে বলিয়ান৷ তারা চান তাদের নিজেদের মতো করে আদালত চলুক৷ সেটা না হলেই তারা নানা অজুহাতে আদালত বর্জন করেন৷ কোনো কোনো বিচারকের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে৷’’ ‘‘তারা যখন আদালতের ওপর দাপট দেখাতে যান তখনই সমস্যা হয়৷ আদলত তো সবার উপরে৷ এটা তো মানতে হবে৷ আইনজীবীদের যেমন কোড অব কন্ডাক্ট আছে, বিচারকদেরও আছে৷ সবার সেটা অনুসরণ করা উচিত৷ অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ জানানো যায়৷ যদি অভিযোগ থাকে সেই পথে যাওয়াই ভালো,’’ বলেন এই আইনজীবী৷

তবে এর পিছনে দুর্নীতিও একটি বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতি বিচারাঙ্গনকেও কলুষিত করছে৷’’

তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল মনে করেন পাস্পরিক শ্রদ্ধা বোধের অভাব থেকে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ তার কথায়, ‘‘আদালত বর্জনের ঘটনা অনেক বড় ঘটনা৷ এটা শুধু আইনজীবী সমিতিই সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ তবে এরকম বড় সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তার পিছনে বড় কোনো কারণ থাকে৷ আসলে আমাদের প্রতিকার পাওয়ার খুব বেশি জায়গা নেই৷’’

আর সাবেক বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘বিচারক এবং আইনজীবীর দ্বন্দ্বের মূল কারণ অজ্ঞতা এবং মানসিকতা৷ বিচারক এবং আইনজীবী বিচারাঙ্গনে সমান মর্যাদার৷ কিন্তু এটা সবাই মানেন না বা মানত পারেন না৷ অনেকে জানেনও না৷ খেয়াল করবেন উচ্চ আদালতের জাজমেন্টে বিচারক এবং আইনজীবী উভয়ের নাম সম্মানের সঙ্গে লেখা হয়৷’’

তিনি জানান, ‘‘ভারতে অধস্তন আদালতেও বিচারক হতে হলে তার কমপক্ষে তিন বছর আদালতে আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকতে হয়৷ আমাদের দেশেও আইনটি ছিল৷ কিন্তু এখন নাই৷ উচ্চ আদালতে আছে৷ তাই সেখানে তেমন সমস্যা হয়না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সরাসরি বিচারক হওয়া এবং আদালতে কয়েক বছর প্র্যাকটিস করার পর বিচারক হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে৷ পারস্পরিক সম্মান ও সমতা বোধের জন্য আমাদের এখন বিচারক নিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে৷’’

এক পাখির দুই ডানা

২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যান বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার৷ তিনি তার বিদায়ী বক্তব্যে বলেন, ‘‘বিচারক ও আইনজীবী একটি পাখির দুটি ডানা৷ একটি ডানা যদি অচল হয়, তাহলে সে পাখির পক্ষে ওড়া অসম্ভব৷ একইভাবে বিচারক ও আইনজীবীর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ছাড়া সুবিচার সম্ভব না৷’’

একই কথা বলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল ৷ তিনি বলেন, ‘‘বিচার ব্যবস্থায় আমরা দুই পক্ষ বিচারক এবং আইনজীবী৷ দুই পক্ষই আদালতে কালো গাউন পরে কাজ করি৷ আমাদের সবার উদ্দেশ্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা৷ আর সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা জরুরি৷’’

আর সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আছে যে, একজন বিচারক ও একজন আইনজীবীর বিচারিক ক্ষেত্রে মার্যাদা সমান৷ দে আর ইকুয়াল পার্টনার৷’’

সাবেক জেলা জজ ড. শাজহান সাজু মনে করেন, ‘‘বার এবং বেঞ্চের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ খুবই জরুরি৷ শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা এবং সমঝোতা ছাড়া এই পরিস্থিতে থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়৷’’

ডয়চে ভেলে

এস. এ টিভি সমন্ধে

SATV (South Asian Television) is a privately owned ‘infotainment’ television channel in Bangladesh. It is the first ever station in Bangladesh using both HD and 3G Technology. The channel is owned by SA Group, one of the largest transportation and real estate groups of the country. SATV is the first channel to bring ‘Idol’ franchise in Bangladesh through Bangladeshi Idol.

যোগাযোগ

বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬,
গুলশান-১, ঢাকা-১২১২,
বাংলাদেশ।
ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০
ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪
ই-মেইল: info@satv.tv
ওয়েবসাইট: www.satv.tv

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩। বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ। ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০, ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

বিচার বিভাগে ‘এক পাখির দুই ডানায়’ দ্বন্দ্ব

আপডেট সময় : ০১:৪৮:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৩

বিচারক আর আইনজীবীর মধ্যে দ্বন্দ্বে বার বার বিপাকে পড়েন বিচার প্রার্থীরা৷ উভয় পক্ষেরই যেখানে ন্যায় বিচারের জন্য কাজ করার কথা, সেখানে কেন এই দ্বন্দ্ব?

বিশ্লেষকরা বলছেন চারটি কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচেছ৷ ১. অজ্ঞতা ২. মানসিকতা ৩. রাজনৈতিক প্রভাব এবং ৪. দুর্নীতি৷

তারা বলছেন, যেসব কারণে বেঞ্চ এবং বারের মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, দেশের আইনেই এর সমাধান থাকলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালত অধস্তন আদালতের এই বিষয়গুলো দেখার দায়িত্বে আছে৷ আর উচ্চ আদালতের বিষয় দেখার জন্য রাষ্ট্রপতি আছেন৷ প্রয়োজনে গঠন হতে পারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল৷ হাইকোর্টের নির্দেশনা হলো, বিচারালয়ে বিচারক এবং আইনজীবী উভয়ই সমমর্যাদার৷

ডেটলাইন ব্রাহ্মণবাড়িয়া

গত ১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে গালাগাল, তার সঙ্গে অশালীন আচরণ ও এজলাসে খারাপ ভাষা ব্যবহার করার ঘটনায় সেখানে অচলবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ আইনজীবীরাও তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং আইনজীবীদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করার অভিযোগে অব্যাহতভাবে সব আদালত বর্জন করছেন৷ অন্যদিকে আদালতের কর্মচারীরাও পাল্টা কর্মবিরতি পালন করছেন৷

আইনজীবীদের দাবি, ওই দিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে কয়েকজন আইনজীবী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকটি মামলা দাখিল করেন৷ কিন্তু দাখিলে বিলম্ব হওয়ার কারণে ওই আদালতের বিচারক মামলাগুলো গ্রহণ করেননি৷ আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামলাগুলো নেওয়ার অনুরোধ করলেও বিচারক তা শোনেননি৷ পরে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সশরীরে ওই বিচারকের এজলাসে গিয়ে মামলাটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন৷ তখন বিচারক তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন৷

এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷ এরপর হাইকোর্ট দুই দফায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ২৪ জনকে আদালতে তলব করেছেন৷ ১৭ এবং ২৩ জানুয়ারি তাদের আদালতে হাজির হতে হবে৷ এরপরও তারা আদালত বর্জন অব্যাহত রেখেছেন৷ তারা এর আগেই আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে চান৷ আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট তানজিল ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমরা জেলা জজ, ট্রাইব্যুনাল -এর বিচারক এবং ওই আদালতের নাজিরের অপসারণ চাই৷ তার আগ পর্যন্ত আদালত বর্জন অব্যাহত থাকবে৷ আমরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা করছি৷ আদালতে তারিখ অনুযায়ী হাজির হবো৷’’

নানা আদালতে দ্বন্দ্ব

গত ২৫ জুলাই এক জামিন শুনানিতে পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও বিচারিক কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় হাইকোর্টে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পান পিরোজপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খান মো. আলাউদ্দিন৷ এরপর গত সেপ্টেম্বরে খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা জজ) বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি পান৷

গত বছরের ২২ নভেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের দুর্ব্যবহার, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে আদালত বর্জন করে জেলা আইনজীবী সমিতি৷

ওই বছরের ১৯ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের আইনজীবীদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগে আদালত বর্জন করেন তারা৷একটি মামলার শুনানি চলার সময় এক বিচারকের সাথে আইনজীবীদের বাকবিতন্ডার জেরে তারা আদালত বর্জন করেন৷

একই বছরের ১৩ জুন লক্ষীপুরের আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেন৷ তারা আদালত চলাকালে আইনজীবীদের সঙ্গে এক বিচারকের অশোভন আচরণের অভিযোগ করেন৷

১৮ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা৷  তারা আদালতের একজন স্টেনোগ্রাফারের বিরুদ্ধে একজন আইনজীবীকে মারধরের অভিযোগ করেন৷

প্রতিবছরই এরম ঘটনা ঘটে চলেছে৷ কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না৷

কেন এই দ্বন্দ্ব

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক প্রভাব এই দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ কোনো বারের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রাজনৈতিক বলে বলিয়ান৷ তারা চান তাদের নিজেদের মতো করে আদালত চলুক৷ সেটা না হলেই তারা নানা অজুহাতে আদালত বর্জন করেন৷ কোনো কোনো বিচারকের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে৷’’ ‘‘তারা যখন আদালতের ওপর দাপট দেখাতে যান তখনই সমস্যা হয়৷ আদলত তো সবার উপরে৷ এটা তো মানতে হবে৷ আইনজীবীদের যেমন কোড অব কন্ডাক্ট আছে, বিচারকদেরও আছে৷ সবার সেটা অনুসরণ করা উচিত৷ অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ জানানো যায়৷ যদি অভিযোগ থাকে সেই পথে যাওয়াই ভালো,’’ বলেন এই আইনজীবী৷

তবে এর পিছনে দুর্নীতিও একটি বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতি বিচারাঙ্গনকেও কলুষিত করছে৷’’

তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল মনে করেন পাস্পরিক শ্রদ্ধা বোধের অভাব থেকে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ তার কথায়, ‘‘আদালত বর্জনের ঘটনা অনেক বড় ঘটনা৷ এটা শুধু আইনজীবী সমিতিই সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ তবে এরকম বড় সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তার পিছনে বড় কোনো কারণ থাকে৷ আসলে আমাদের প্রতিকার পাওয়ার খুব বেশি জায়গা নেই৷’’

আর সাবেক বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘বিচারক এবং আইনজীবীর দ্বন্দ্বের মূল কারণ অজ্ঞতা এবং মানসিকতা৷ বিচারক এবং আইনজীবী বিচারাঙ্গনে সমান মর্যাদার৷ কিন্তু এটা সবাই মানেন না বা মানত পারেন না৷ অনেকে জানেনও না৷ খেয়াল করবেন উচ্চ আদালতের জাজমেন্টে বিচারক এবং আইনজীবী উভয়ের নাম সম্মানের সঙ্গে লেখা হয়৷’’

তিনি জানান, ‘‘ভারতে অধস্তন আদালতেও বিচারক হতে হলে তার কমপক্ষে তিন বছর আদালতে আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকতে হয়৷ আমাদের দেশেও আইনটি ছিল৷ কিন্তু এখন নাই৷ উচ্চ আদালতে আছে৷ তাই সেখানে তেমন সমস্যা হয়না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সরাসরি বিচারক হওয়া এবং আদালতে কয়েক বছর প্র্যাকটিস করার পর বিচারক হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে৷ পারস্পরিক সম্মান ও সমতা বোধের জন্য আমাদের এখন বিচারক নিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে৷’’

এক পাখির দুই ডানা

২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যান বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার৷ তিনি তার বিদায়ী বক্তব্যে বলেন, ‘‘বিচারক ও আইনজীবী একটি পাখির দুটি ডানা৷ একটি ডানা যদি অচল হয়, তাহলে সে পাখির পক্ষে ওড়া অসম্ভব৷ একইভাবে বিচারক ও আইনজীবীর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ছাড়া সুবিচার সম্ভব না৷’’

একই কথা বলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল ৷ তিনি বলেন, ‘‘বিচার ব্যবস্থায় আমরা দুই পক্ষ বিচারক এবং আইনজীবী৷ দুই পক্ষই আদালতে কালো গাউন পরে কাজ করি৷ আমাদের সবার উদ্দেশ্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা৷ আর সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা জরুরি৷’’

আর সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আছে যে, একজন বিচারক ও একজন আইনজীবীর বিচারিক ক্ষেত্রে মার্যাদা সমান৷ দে আর ইকুয়াল পার্টনার৷’’

সাবেক জেলা জজ ড. শাজহান সাজু মনে করেন, ‘‘বার এবং বেঞ্চের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ খুবই জরুরি৷ শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা এবং সমঝোতা ছাড়া এই পরিস্থিতে থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়৷’’

ডয়চে ভেলে