তামিমের কান্না যখন বাংলাদেশের কান্না
- আপডেট সময় : ০৫:৫৬:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই ২০২৩
- / ১৭১০ বার পড়া হয়েছে
টেলিফোনের অন্য প্রান্তে হাবিবুল বাশার স্তম্ভিত৷ বাংলাদেশ উদীয়মান দলের ম্যনেজারের দায়িত্ব পালন করতে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় আছেন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক৷
সেখান থেকেই চোখ রাখছিলেন জাতীয় দলের কার্যক্রমে৷ আফগানিস্তান সিরিজের খোঁজ খবর রাখাটা তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে৷ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কের পাশাপাশি একজন জাতীয় নির্বাচকও তিনি৷
সিরিজের মাঝ পথে তামিম ইকবাল এমন একটা ঘোষণা দিয়ে বসতে পারেন এটা তার কাছে কল্পনারও অতীত৷ খবরটা জানাতেই কিছুক্ষণ তিনি শব্দহীন৷ অনেকটা সময় আবেগকে ধরে রেখে শুধু একটা বাক্যই উচ্চারণ করতে পারলেন, ‘‘বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার তামিম৷”
চোখের কোণও কী একটু ভিজে উঠেছিলো তার? তামিমের কাছে তিনি তো শুধু জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বা নিছকই একজন জাতীয় নির্বাচক নন৷ জাতীয় দলে তামিমের প্রথম অধিনায়কও ছিলেন তিনি৷
আজকের দিনটা শুধু তামিমের চোখের জলে বিদায় বলে দেওয়ার দিন নয়৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরো অসংখ্য মানুষের জন্যই এই দিনটা আবেগের৷ মাঠে, মাঠের বাইরে কতো স্মৃতিইতো তামিম উপহার দিয়েছেন সবাইকে৷ তামিমের অবসর ঘোষণা প্রায় সবার জন্যই একটা বিরাট ধাক্কা৷
মুখে যতোই বলুন, কদিন ধরেই অবসর নিয়ে পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন, এমন একটা ঘোষণা দেওয়ার জন্য সম্ভবত তামিম নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না৷ সংবাদ সম্মেলনে যখন এলেন চোখ অনেকটা লালচে। বোঝাই যাচ্ছিলো, অনেকটা সময় কান্নাকাটি করেছেন৷ হয়তো একাই৷
শুরুতে বেলা ১২টায় সংবাদ সম্মেলনে আসবেন বলেছিলেন৷ এলেন আরো ঘণ্টা দেড়েক পর৷ হয়তো এই সময়টায় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন৷ কখনো বা নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন৷ নিজের সিদ্ধান্ত নিজে কাঁটা ছেড়া করেছেন৷ তার হাতে তো একাধিক অপশন ছিলো৷ চাইলে শুধু জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে পারতেন৷ কিংবা ওয়ানডে ছেড়ে দিয়ে আরো কিছুদিন টেস্ট চালিয়ে যাওয়া কথা বলতে পারতেন৷ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে একেবারেই বিদায় বলে দেয়া ছিলো চরমতম সিদ্ধান্ত৷ তামিম সেটাই বেছে নিয়েছেন৷
তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে সবাই আবেগের বাড়াবাড়ি দেখলেও তামিম হয়তো নিজেকে বিজয়ীই ভাবতে চেয়েছেন৷ তার মতো করে বাংলাদেশের প্রায় আর কোনো অধিনায়কই যে বিদায় নিতে পারেনি৷ অনেক বছর আগে মুশফিকুর রহিম জিম্বাবুয়েতে এরকম একটা আবেগতাড়িত ঘোষণা দিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেটা ছিলো কেবলই অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা৷ নিছকই ছেলেমানুষি, অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত, যা মুশফিক নিজেও পরে বুঝতে পেরেছেন এবং সিদ্ধান্ত বদল করেছেন৷
তামিম তার সিদ্ধান্ত বদলাবেন কি-না সেটা সময়ই বলে দেবে৷ তবে এই ঘটনার পেছনের যে প্রেক্ষাপট তাতে সেরকম সম্ভাবনা সামান্যই৷ আফগানিস্তান সিরিজটি নিশ্চয় তামিম অবসর নেবেন ভেবে শুরু করেননি৷ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তিন বছর আগেই তাকে অধিনায়ক করা হয়েছিলো৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফি ছাড়া আরে কোনো ক্রিকেটারকে এতটা লম্বা সময় দেয়া হয়নি৷ তাহলে সেই টুর্নামেন্ট শুরুর তিন মাস আগে কেন তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন?
কারণটা সম্ভবত প্রায় সবারই জানা৷ তবু বলি, শতভাগ ফিট না হয়েও প্রথম ম্যাচে তার খেলার সিদ্ধান্তের যে কড়া সমালোচনা বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান করেছেন তামিম তা নিতে পারেননি৷ সমালোচনাটা মোটেও অন্যায্য ছিলো না৷ কিন্তু সিরিজের মাঝপথে অধিনায়কের এমন প্রকাশ্য সমালোচনা কতোটা ন্যায্য সেই প্রশ্ন রাখাই যায়৷
বিসিবি সভাপতি তামিমের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেছেন৷ তা তিনি করতেই পারেন৷ তবে বিসিবির ঠিক কোথায় কোথায় পেশাদারত্ব আছে সেই প্রশ্নে তার নিশ্চুপ থাকা ভিন্ন কোনো উপায় কী আছে৷ জাতীয় দল নিয়ে তার অতিকথন আগেও সমালোচিত হয়েছে৷ এখনতো এটা বাংলাদেশকে এটা একটা বিরাট ক্ষতির মুখেই ঠেলে দিয়েছে৷
সিরিজে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ০-১ ব্যবধানে পিছিয়ে আছে৷ আজ ছিলো ভুল ভ্রান্তি খুঁজে বের করার দিন৷ কিন্তু সেটা না করে এখন পরের ম্যাচের জন্য অধিনায়ক খুঁজতে হচ্ছে৷ সামনে আরো বড় ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে দল নিশ্চিতভাবেই৷
টানা প্রায় ১৭ বছর ওয়ানডে দলে খেলছেন তামিম৷ ইনজুরি ছাড়া এক ম্যাচের জন্যও দল থেকে বাড় পড়েননি৷ বাংলাদেশে এই রেকর্ড আর কোনো খেলোয়াড়ের নেই৷ এমনকি সাকিব, মাশরাফিরও নেই৷ ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাদেরও বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু তামিমের কখনো এই অভিজ্ঞতা হয়নি৷ বিসিবিকে এখন এমন একজন খেলোয়াড় এবং অধিনায়ক তামিমের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে, এবং তা আগামীকালই৷ একদিন পরই যে আফগানিস্তানের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচ৷ বিশ্বকাপও তো মাত্র তিন মাস দূরে৷
একটা ক্রিকেট বোর্ডে পেশাদারত্বের সামগ্রিক ঘাটতি থাকেলেই কেবল দল এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারে৷ চাইলে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিকেও এজন্য দায়ী করা যায় অনায়েসেই৷ নিজেদের ক্যারিয়ারে কখন থামতে হবে বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারের সেই পরিকল্পনা থাকে না৷ যদিও বা কারো সেই পরিকল্পনা থাকেও সবাই মিলে পরিস্থিতি এমন করে তোলেন যে মাঠ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার প্রায় কারো সুযোগ থাকে না৷ খালেদ মাহমুদ ছাড়া আর কোনো সাবেক অধিনায়ক এই সুযোগ পাননি৷ মাশরাফি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণা দিয়েছেন টসের সময়৷ ওয়ান ডে থেকেতো বিদায় নিতেই পারেননি৷
এই লেখা যখন লিখছিলাম ইংল্যান্ড থেকে ফোন করেছেন মোহাম্মদ আশরাফুল৷ তামিমের সিদ্ধান্তে হাবিবুল বাশারের মতো তিনিও বিস্মিত৷ তবে এবার তাকে এতটা আবেগ তাড়িত মনে হয়নি৷ অনেকটা উদাস স্বরে বললেন, ভালোই করেছে তামিম৷ চারদিক থেকে ন্যায্য, অন্যায্য এত সমালোচনা হচ্ছিলো যে তার এ থেকে বাঁচার জন্য এর চেয়ে ভালো কিছুতো হাতে ছিলোও না৷ আশরাফুলের কণ্ঠেও বিষণ্ণতার সুর৷ তামিম তবুও বিদায় বলার সুযোগ পেয়েছেন৷ আশরাফুল তো সেই সুযোগও পাননি৷ যতই তাকে ম্যাচ ফিক্সিং বিতর্ক ঘিরে থাকুক, বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম সুপারস্টার তো তিনি৷
কিন্তু বাংলাদেশ আর কবে কাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিয়েছে৷ কান্নাই বাংলাদেশের সব তারকার শেষ পরিণতি৷ তামিম তা-ও ভাগ্যবান৷ নিজেরে শহরে, স্মৃতির চট্টগ্রামে বিদায় বলতে পেরেছেন৷ আশরাফুল, হাবিবুল বাশারদের যতো কান্না, আবেগ সব অন্ধকারে মিশে গেছে৷
ডয়চে ভেলে