একটি সেলফি ও উদ্দেশ্য হাসিলের রাজনীতি
- আপডেট সময় : ১১:১৮:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ১৭৫১ বার পড়া হয়েছে
গত সপ্তাহান্তে নতুন দিল্লিতে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনকেন্দ্রের ভেতরে ঘোরাঘুরির সময় একসঙ্গে সেলফি তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল৷ এই যে লাইনটা আপনি এইমাত্র পড়লেন তাতে কি কোনো ভুল আছে?
আরেকবার পড়ুন৷ সাদা চোখে এখানে ভুল কিছু দেখার কথা নয়৷ একটি সেলফিতে তিনজনকে দেখা যাচ্ছে৷ এরকম অসংখ্য সেলফি অসংখ্য মানুষ তোলেন৷ আর জো বাইডেনের তো বিশেষ নামই আছে সেলফি তোলার জন্য৷ এমনকি কারো সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় তার হাতটা কিছু সময় ধরে রাখাটাও তার পুরোনো অভ্যাস৷
কিন্তু এই সেলফিটাকে বাংলাদেশে নিজেদের পছন্দমতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দিতে ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিম থেকে গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে দ্রুত সেটি প্রকাশ করতে৷ সরকারের এমপি, মন্ত্রীরা ফেসবুকে ছবিটি শেয়ারের সময় ইঙ্গিতপূর্ণ ক্যাপশন দিয়েছেন: ‘‘ছবিটা কে তুলেছে মনে হয়?”
পুরো সেলফিটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগ বাড়িয়ে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফিটি তুলেছেন৷ সেলফিকেন্দ্রিক পুরো প্রচারণাতে এই ইঙ্গিত দেয়ারও চেষ্টা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ব়্যাবের উপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেগুলোর আর কোনো গুরুত্ব নেই৷ বরং অ্যামেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আবার ভালো হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ, সেলফির আড়ালে হারিয়ে গেছে সব সমালোচনা!
বাস্তবে নতুন দিল্লিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কোনো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বা আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি৷ বিশ্বের বিশটিরও বেশি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানের একটি সম্মেলনে একে অপরের মাঝে দেখা হয়েছে শুধু৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যেমনটা জানিয়েছেন যে, সম্মেলনকেন্দ্রে বাইডেনের কাছে গিয়ে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কথা বলতে চান৷ তখন অনেকের মাঝে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট কথা হয়েছে তাদের৷ সেসময় বাংলাদেশি এক কর্মকর্তা ছবি তুলতে চাইলে জো বাইডেন সেই ব্যক্তির ফোনটি নিয়ে একসঙ্গে সেলফিটি ক্লিক করেছেন৷ ফোনটা বাইডেনের নিজের নয় এবং এটি মার্কিনিদের তরফ থেকে কোনো পূর্ব পরিকল্পিত ব্যাপারও নয়৷
হাসিনা ও বাইডেনের মধ্যে নতুন দিল্লিতে যে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি সেটা হোয়াইট হাউসও পরিষ্কার করেছে এবং তাদের মধ্যকার কুশল বিনিময় নিয়ে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক কিছুই প্রকাশ করেনি৷ আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে যে কড়া অবস্থান ওয়াশিংটনের তাতেও এই লেখা প্রকাশের সময় অবধি কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই৷
কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে মনে হবে এক সেলফি তুলেই বিশাল অর্জন হয়ে গেছে ক্ষমতাসীনদের! এখন আগামী নির্বাচন কী হলো না হলো তাতে কিছু যায় আসে না৷
সুপরিকল্পিতভাবে এমন প্রচারণার উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে দেশের মধ্যে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে যারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি করছেন তাদের মনোবল ভেঙে দেয়া যায়৷ পাশাপাশি বিরোধী দলের এ সংক্রান্ত আন্দোলন দমনে নিয়মবহির্ভূতভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহারের এবং অসংখ্য মানুষকে বিচারিক হয়রানি করার যে অভিযোগ উঠেছে নানা তরফ থেকে, সেটাও যাতে চেপে যাওয়া যায়৷
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যে এখন অবধি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ কিংবা অংশগ্রহণমূলক হওয়া থেকে অনেক দূরে তা একটি পরিসংখ্যান দেখলেই পরিষ্কার হয়৷ কিছুদিন আগে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে মামলা করা হয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার এবং সেসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ।
দেশি-বিদেশি আরো কয়েকটি পত্রিকায় এরকম নানা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে৷ কিন্তু গণমাধ্যম ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির বড় নেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতা অবধি অনেকের বিরুদ্ধে করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে, যেগুলোতে তারা শাস্তি পাচ্ছেন এবং অনেক পুরোনো মামলা নতুন করে চাঙ্গা করার পাশাপাশি নতুন মামলাও করা হচ্ছে৷
গণমাধ্যম এই তথ্যও প্রকাশ করেছে যে, অনেক মামলা এমন সব ঘটনায় করা হয়েছে যা বাস্তবে আদৌ ঘটেনি৷ কিছু মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের তালিকা ধরে এমন মানুষদেরও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যারা ঘটনার আগেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন৷
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ বিএনপি৷ এখন এই দলটিকে নির্বাচনের আগেই মামলার জালে জড়িয়ে এমনভাবে কাবু করে ফেলা হচ্ছে, যাতে এটি কোনো ধরনের আন্দোলন করারই সামর্থ্য হারায়, নির্বাচনে অংশ নেয়াতো পরের কথা৷ আর এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীনরা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
বিষয়টি এমন নয় যে, শুধু আওয়ামী লীগই বুঝি ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে৷ দূর অতীতেও অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে, বিরোধী দলকে দুর্বল করেছে৷ কিন্তু সেগুলো যেমন নিন্দনীয় ছিল, তেমনি এখন আওয়ামী লীগের যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে চেষ্টা দৃশ্যত ফুটে উঠেছে তা-ও নিন্দনীয়৷ যে দল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেটির এমন ভাবমূর্তি সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার৷ দেশের মানুষের মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, ভোটের অধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা থাকা উচিত ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দলটির৷ কিন্তু দৃশ্যত এখন হচ্ছে তার উল্টো৷
আরেকটি কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি, বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকারের দুর্বলতা যতই থাক না কেন সেদেশের সরকারপ্রধানকে আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার না করলে তা হবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন৷ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যে সম্মান পাচ্ছেন সেটা তার প্রাপ্য এবং এটাই হওয়া উচিত৷
তাই অন্যান্য সভ্য দেশের সরকারপ্রধানদের তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাকে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বলতার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে বিজয়ের প্রচারণা চালানোটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য সম্মানহানিকর৷ মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার সমর্থকরাই এই স্বাভাবিক সম্মানটুকুও আশা করেননি৷ ফলে এটা তারা সবাইকে নানা রঙে রাঙিয়ে দেখাতে চাচ্ছেন৷ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি কি এই মানসিক দৈনদশার কারণ?
ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ