বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ: বর্তমান প্রেক্ষাপট
- আপডেট সময় : ০৪:৩২:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ অক্টোবর ২০২৩
- / ১৬৬৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ দমনে আইনের প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি জরুরি পরিবারের ভূমিকা৷ সমাজের বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন,তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে কিশোর অপরাধ দমনে৷
গত ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২৩’ উদযাপন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,আজকের শিশু-কিশোররাই আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ চালাবে৷ বক্তব্যটি আশাব্যঞ্জক নিঃসন্দেহে৷ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ এখন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে আমাদের এই যাত্রা একদিকে যেমন নতুন আশার সঞ্চার করছে, তেমনি কতগুলো প্রশ্নের সামনেও আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে৷ সমাজের প্রচলিত নানা অপরাধের ধরন পাল্টেছে,এমনকি ডিজিটাল ও স্মার্ট মাধ্যমকে ব্যবহার করে অপরাধপ্রবণতাও বাড়ছে চারপাশে৷
গত দুই দশকে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ নানাভাবে আলোচনায় এসেছে৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কিছু ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে কিশোর অপরাধের ধরনধারণ দেখলে আমাদের গা শিউরে ওঠে৷ বর্তমানে কিশোর অপরাধের পরিধিও অন্যান্য অপরাধের মতো বেড়েছে৷ বিশেষ করে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার না থাকায়,কিশোর অপরাধ একটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে৷ এই বাস্তবতাগুলো সামনে রেখে শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখতে গেলে নিজেদেরকে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে হয়৷ আমরা সত্যিই কি পারছি আমাদের শিশু-কিশোরদের স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে?
কিশোর অপরাধ আমার মতে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ ব্যাপারটি এমন নয় যে,হঠাৎ করেই কিশোররা নানা ধরনের ‘গ্যাং-কালচার’-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে৷ ২০১৩ সাল থেকে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রায় ২৫টি কিশোর অপরাধের সংবাদ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়,প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে পরিবার,সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার নানা সংযোগ রয়েছে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী৷ সুতরাং এককভাবে কেবল কিশোর অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব,এটা ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না৷
একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি পরিষ্কার করা সম্ভব৷ কিশোরদের মানসিকতায় যে ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করে,তার একটি বড়ো অংশ তৈরি হয় প্রচলিত সমাজব্যবস্থা থেকে৷ সমাজে নৈরাজ্য বিরাজ করলে কিশোর-কিশোরীদের মানসিকতায় সে নৈরাজ্যের একটি প্রভাব পড়ে৷ সে তখন তার অংশ হতে চায়৷ এটা যে কেবল বর্তমানের কিশোর-কিশোরীদের সমস্যা,তা কিন্তু নয়৷ আশির দশকে যারা কিশোর ছিলেন,তাদের অনেকের কাছেই আমি শুনেছি বা এখনও শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ত্রাস গোলাম ফারুক অভিকে তাদের ভালো লাগত৷ আমি যখন পাল্টা প্রশ্ন করি,কেন একজন সন্ত্রাসীকে আপনাদের ভালো লাগতো,তখন তারা যে উত্তরটি দেয়,আজকের কিশোর-কিশোরীরাও তাদের এ ধরনের পছন্দের ক্ষেত্রে খুব একটা ভিন্ন উত্তর দেয় না৷ তাহলে পরিস্থিতিটি দাঁড়াচ্ছে এই যে,সমাজে সন্ত্রাস বিস্তারে যে ব্যক্তিটি দায়ী,কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রীক ফ্যান্টাসির কারণে কিশোর-কিশোরীরা তাকে পছন্দ করছে৷ তার অবৈধ অস্ত্রটিকে মনে করছে তার অলংকার৷
এই পরিস্থিতিই একটু ভিন্নভাবে কাজ করছে বর্তমান সময়ে৷ আজকের কিশোর-কিশোরীদের মনস্তত্ত্বে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নানা ধরনের বিষয়৷ সবগুলো এখন আর ফ্যান্টাসির মধ্যে নেই,কোনো কোনোটি সে তার বাস্তবজীবনে প্রয়োগও করতে পারছে৷ ধরা যাক,গুরুত্বপূর্ণ কোনো উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী বা রাজনৈতিক নেতার সন্তান তার পরিবারকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে দেখে৷ ফলে ওই কিশোর অল্প বয়সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে চায়৷ আমি বলছি না সকলেই এ ধরনের,কিন্তু সংশ্লিষ্টরা একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলেই দেখবেন, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তাদের অভিভাবকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অবস্থানটি সক্রিয় থাকে৷ কী রাস্তাঘাটে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে,রেস্তোঁরায় বা বিনোদনকেন্দ্রে তারাঅনায়াসে সেই ক্ষমতাটি ব্যবহার করতে চায়৷ এর জন্য কিন্তু সেই কিশোর বা কিশোরী দায়ী নন,দায়ী তার অভিভাবক;কারণ ওই অভিভাবক তাকে শিখিয়েছে, কীভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়৷ একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী বা রাজনৈতিক নেতা যখন তার সন্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিভাবকের পরিচয় বাদ দিয়ে পেশাগত পরিচয় নিয়ে হাজির হয় বা তার প্রশাসনিক ক্ষমতা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করে,তখন তার সন্তানের মাঝে একধরনের মিথ্যা ‘হিরোইজম’ তৈরি হয়৷ তার কাছে শিক্ষক বা শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়টি গুরুত্ব পায় না৷ এ ধরনের অনেক ঘটনা আমরা দেখেছি,যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে৷ কারণ সে জানে,সমাজে শিক্ষকের কোনো মর্যাদা নেই৷ এই একই ঘটনা বাকি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলে ভিন্নভাবে৷ একই ক্লাশে পড়া দুজন শিক্ষার্থীর একজন যখন তার বাবা-মায়ের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেন নানাভাবে,তখন অন্যজন নিজেকে বঞ্চিত ভাবে,কারণ তার পরিবারের সে ক্ষমতা নেই৷ ফলে নিজের পরিবারের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয় তার৷ ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য সে পরিবারের চেয়েও ক্ষমতাবান কাউকে আশ্রয় করে৷ এভাবেই শুরু হয় গ্যাং-কালচার৷ সে তখন ভিন্নভাবে ক্ষমতাবান হওয়ার চেষ্টা করে৷
আমি মনে করি,অভিভাবকের প্রশাসনিক বা আর্থিক ক্ষমতা ও পেশাগত অবস্থানের যে রোশনাই সমাজে বিরাজ করছে,সেটা কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রধান কারণ৷ সমাজে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যে ব্যবস্থা চলমান,সেটা বজায় রেখে কোনোভাবেই কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়৷ এর সঙ্গে পরিবারের শিক্ষাটিও গুরুত্বপূর্ণ৷ সন্তান যদি মনে করে সরকার থেকে দেওয়া বাবা কিংবা মায়ের গাড়িটি সে-ও ব্যবহার করতে পারে,তখন সে সন্তানের মাঝে কখনোই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মাবে না৷ কারণ তার শুরুটাই হলো একটি আইনভঙ্গের মাধ্যমে৷ মা-বাবার দায়িত্ব সন্তানকে এ বিষয়টি বোঝানো৷
বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার কিশোর অপরাধকে আরও জটিল করে তুলেছে৷ এখন এই অপরাধের সীমা কেবল আর গ্যাং-কালচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক নানা অপরাধও এখানে ঘটছে,ঘটছে মাদকদ্রব্য ব্যবহার ও বিপণনের মতো অপরাধও৷ এর মূল কারণ প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার৷ যেভাবে ইউটিউবের একটি ভিডিওর মধ্যে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তাতে যে কোনো বয়সের ব্যক্তিই সহজে সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িত হতে পারে৷ এ বিষয়ে সরকারের কোনো ধরনের নীতিমালাও আমাদের চোখে পড়ে না৷ বিভিন্ন অনলাইন মেসেজ অ্যাপ যেভাবে মাদক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো৷ ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার কেবল নিশ্চিত করলেই হবে না,কোন বয়সের মানুষ সে প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করছে, তারও একটি নির্দেশনা ও নজরদারি থাকা জরুরি৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদেই আমি দেখেছি, বর্তমানে অনেক কিশোর-কিশোরী এমনসব দামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন, যা বেমানান তো বটেই,তার প্রয়োজনীয়ও নয়৷ পরিবারই তার হাতে এই ফোনটি তুলে দিচ্ছে,কিন্তু ফোনে তার কার্যক্রম কী সেটা পরিবার জানতে পারছে কি?
ফলে আমি মনে করি,বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ দমনে আইনের প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি জরুরি পরিবারের ভূমিকা৷ সমাজের বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন,তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে কিশোর অপরাধ দমনে৷ আর এই ভূমিকাগুলো মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়,বরং সমন্বিত কর্ম-পরিকল্পনা থাকাটা জরুরি৷ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার যে উৎকট রূপ আমরা দেখি,তা যেমন দমন করা প্রয়োজন;তেমনি প্রয়োজন পরিবারের আদর্শিক অবস্থান৷ বর্তমানে বাংলাদেশে পারিবারিক আদর্শ বিষয়টি প্রায় বিলুপ্ত৷ আইনের প্রয়োগ করে কিশোর অপরাধীদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে,কিন্তু পরিবার ও সমাজের যৌথ পরিকল্পনা না থাকলে কিশোর অপরাধকে দমন করা সম্ভব নয়৷
ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ