অভিযোগ উঠলেই চিকিৎসক গ্রেপ্তার করা যাবে না- ডা. জামালউদ্দিন
- আপডেট সময় : ০৪:৪৯:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ জুলাই ২০২৩
- / ১৫৬৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে চিকিৎসকদের আন্দোলন কবে থেকে শুরু? কেন তারা আন্দোলন করেন? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ -স্বাচিপ এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামালউদ্দিন চৌধুরী।
ডয়চে ভেলে : চিকিৎসকদের যে আন্দোলন, সেটা কবে থেকে শুরু হয়েছে?
অধ্যাপক ডা. জামালউদ্দিন চৌধুরী : এটা তো সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন হয়েছে। আমরা যখন মেডিকেল কলেজে পড়ি ১৯৭৮ সালে পে কমিশনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ২১ দফা নিয়ে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই ২১ দফা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এরপর সে ধরনের কোন আন্দোলন হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন হয়েছে।
উন্নত দেশ অর্থাৎ ইউরোপেও আমরা চিকিৎসকদের ধর্মঘট দেখেছি। আপনাদের আন্দোলন, আর তাদের আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য কী?
যুক্তরাজ্য যদি বলেন, সেখানে আন্দোলন হয়। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি, সেখানে বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ডাক্তারদের আন্দোলন হয়েছে। সেটা ছিল খুবই স্ট্রং আন্দোলন। চিকিৎসকেরা সেখানে স্ট্রাইক করেছিলেন। সেটা নিয়ে সরকার খুব বিপদেও পড়েছিল তখন। অন্য রাষ্ট্রের কথা আমি জানি না, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা জানি। সেখানে কিন্তু মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনকে ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে ট্রিট করা হয়। আমরা কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন না। তারপরও আমরা সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করি। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনও করে।
চিকিৎসকেরা আন্দোলন করে নিজেদের দাবির কথা বলেন। আপনারা কী কখনও রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করা কথা বলেছেন?
সবসময়ই আমরা এ কথা বলি। চিকিৎসকেরা সব সময় চেষ্টা করেন রোগীকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার। কোন চিকিৎসকই চান না যে রোগীর ভুল চিকিৎসা হোক বা তারা দুর্ভোগে পড়ুক। অবহেলার অভিযোগ কিন্তু সারাবিশ্বেই আছে। আমেরিকাতে ২০১৮ সালের সার্জারিগত কারণে চার হাজার অভিযোগ জমা পড়েছিল। এরপর ওষুধ বলুন বা অন্যান্য বিষয় বলুন সেগুলো আরও অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সব অভিযোগ যে সত্যি হয়, তা কিন্তু না। যেগুলো প্রমাণ হয়, সেগুলোর অবশ্য শাস্তিও হয়।
বাংলাদেশে চিকিৎসার মান কেমন?
দেশে চিকিৎসার মান কিন্তু আগের চেয়ে অনেক অনেক ভালো হয়েছে। আপনি হৃদরোগ বলেন, কিডনি বলেন, ক্যান্সার বলেন অনেক ব্যাপারে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। হ্যাঁ, আমরা পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো এখনই হয়ে যাব, এটা ভাবা ঠিক না। আমাদের থেকে অনেক আগে তারা প্রযুক্তিগুলো গ্রহণ করেছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারণে এখন এগুলো আমরা চিন্তা করছি। অন্যান্য সেক্টরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাও এগিয়ে যাচ্ছে। এখন কিন্তু উপজেলা পর্যায়েও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায়। যা আগে কখনও চিন্তা করা যায়নি।
তাহলে দেশের এত মানুষ কেন বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান?
আগে তো আরও বেশি যেত। এখন আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে। বড়লোকেরা কিছু হলেই বিদেশে চলে যান। এটা তো থাকবেই। গরিবরা তো এখানে চিকিৎসা পাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি হাসপাতালগুলো যে চিকিৎসা দিচ্ছে সেটা প্রশংসা পাওয়ার মতো। করোনার সময় দুই বছর কেউ কিন্তু বাইরে যেতে পারেনি। এই দুই বছর ধনীরা তো এখানে চিকিৎসা নিয়েছে। সামান্য অসুখে যারা বিদেশে যায় তারাও তো ওই সময় এখানে চিকিৎসা নিয়েছে। এতে যে মৃত্যু বেশি হয়েছে সেটা তো কেউ বলতে পারছে না। সুতারাং বাংলাদেশে চিকিৎসার মান যে ভালো সেটা তো প্রমাণিত।
চিকিৎসকদের বেতন ও ভাতা বাড়ানো হলেই কী চিকিৎসার মান উন্নত হবে?
আমি যেটা বুঝি, অনেক দেশেই চিকিৎসকদের পে স্কেল ভিন্ন। বাংলাদেশে সবাইকে একই মাপে বেতন দেওয়া হয়। সরকারের যেহেতু সীমাবদ্ধতা আছে, ফলে চিকিৎসকদের সেভাবে বেতন দিতে পারছে না। চিকিৎসকদের সুযোগ সুবিধা যদি বাড়ানো হয় তাহলে তারা আরও বেশি কাজে মনোযোগী হবেন সেটা তো স্বাভাবিক। চেম্বারে বেশি সময় অর্থ উপার্জনের চিন্তা তখন তাকে আর করতে হবে না।
সম্প্রতি সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসায় ভুলের কারণে প্রসূতি-সন্তানের মৃত্যু হল। এর দায় কী হাসপাতালের নাকি চিকিৎসকের?
এটা একটা জটিল বিষয়। ওই রোগী কিন্তু কয়েক ঘন্টা কুমিল্লায় চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানে তারা নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করেছিল। সেখানে কিন্তু তাকে সিজারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কারণ ওই রোগীর নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সুযোগ ছিল না। শেষ পর্যন্ত রোগী এতটা পথ জার্নি করে ঢাকায় চলে আসল। এখানেও তারা নরমাল ডেলিভারির জন্য উদ্বুদ্ধ করল। পরে দেখা গেল বাচ্চাটার ওজন সাড়ে ৪ কেজি। যেটা কোনভাবেই নরমাল ডেলিভারির সুযোগ নেই। কিন্তু কেন দেরি করা হল সেটা আমি জানি না। এটা করতে করতে রাত হয়েছে। তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন না। তাদের অন কলে ডাকতে হয়। এক পর্যায়ে সিজার করা হল। তবে মেডিকেল অফিসাররা এটা করতে পারেন না। অনেক সময় তারাও সিজার করেন। তবে না করাই ভালো। যেখানে সুযোগ ছিল, সেখানে একজন এমবিবিএস ডাক্তার কেন সিজার করলেন সেটা নিয়ে তো প্রশ্ন থাকতেই পারে। একটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে কমিটি করার পর তারা যে রিপোর্ট দেবেন সেটা দেখেই নিশ্চিত হওয়া যাবে আসলে সেদিন ওখানে কী ঘটেছিল।
যাদের অবহেলায় এই মৃত্যু, তাদের গ্রেফতার করায়ও চিকিৎসকেরা ধর্মঘটে গেলেন। তাহলে কী অবহেলায় রোগী মারা গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না?
এখানে যে মামলাটি হয়েছে সেটা ৩০৪ এর ক ধারায়। তার মানে এটা অবহেলার জন্য। অবহেলার জন্য তো একজন চিকিৎসককে প্রাথমিকভাবে গ্রেপ্তার করতেই পারে না। আইনেই বলা আছে, তাকে গ্রেপ্তার করতে হলে প্রাথমিকভাবে একটা বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে কমিটি করতে হবে। তারা যদি প্রাথমিকভাবে দেখেন সেখানে অবহেলার উপাদান আছে, তাহলে আপনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাতে আইন আছে, সেখানে কোন অবস্থাতেই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা যায় না। হ্যাঁ, বিচার বিচারের মতো চলবে। আদালতে শুনানি হবে। সেখানে যদি অপরাধ প্রমাণ হয় তাহলে ব্যবস্থা নেন। কিন্তু আমাদের দু’জন লেডি ডাক্তারের জামিন তিনবার ক্যান্সেল হয়েছে। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেতে হয়েছে। আমি আইনজীবীদের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলেছি। তাদের কেন জামিন দেওয়া হবে না? বিচার তো চলতেই পারে। কিন্তু ওই দুইজন লেডি ডাক্তারের তো পরিবার আছে, সন্তান আছে। এই জায়গাগুলো তো আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। সেজন্যই চিকিৎসকেরা প্রথমে মানববন্ধন করেছেন। তারপর তারা প্রতিবাদ করেছেন। তারপরও কাজ না হওয়ায় চিকিৎসকরা ধর্মঘটে গেছেন। তবে আমি মনে করি, ধর্মঘটে যাওয়ার আগে আরও একটু চিন্তা ভাবনা করার দরকার ছিল। ডাক্তাররাতো প্রাইভেট হাসপাতালে চেম্বার বন্ধ করেছিল। তবে সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালু হওয়ায় রোগীদের ভোগান্তি একটু কমেছে বলে আমার মনে হয়েছে। যদিও ধর্মঘট একদিনের জন্য হয়েছে। জামিন হওয়ার পর চিকিৎসকেরা কিন্তু সেখান থেকে সরে এসেছে।
রোগী ও চিকিৎসকদের উভয়ের অধিকার রক্ষা করে, এমন কী উপায় গ্রহণ করা যায়? সরকারের এক্ষেত্রে করণীয় কী?
আমরা চেয়েছিলাম উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো ডাক্তার প্রটেকশন এ্যাক্ট করার। সেখানে নার্সদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে কর্মক্ষেত্র নিরাপদ রাখতে। অনেক বছর চলে গেছে, বাংলাদেশে সেটা আলোর মুখ দেখেনি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এটা হলে খুবই ভালো হয়। আর দ্বিতীয়ত, কোড অব প্রফেশনাল কনডাক্ট, যেটা মানতে হয় ডাক্তারদের। সেখানে কিন্তু বিস্তারিত আছে, কীভাবে একটা রোগী দেখতে হবে। এটা আমাদের চিকিৎসকদের পড়তে হবে। এতে রোগীদের স্বার্থ সুরক্ষা হবে। ডাক্তার প্রটেকশন এ্যাক্ট যে আমরা চাচ্ছি, সেটা যদি পাশ হয় তাহলে ডাক্তার ও রোগী উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষা হবে।
ডয়চে ভেলে