০২:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত

এস. এ টিভি
  • আপডেট সময় : ০৯:৫০:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ১৬৭৯ বার পড়া হয়েছে
এস. এ টিভি সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

টানা কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে৷ এ খাতে এখন তার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট৷

অথচ আর্থিক খাতের বড় শক্তিই হওয়ার কথা ছিল আস্থা ও বিশ্বাস৷ যেমন, আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে আমানতকারীরা তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ জমা রাখে ব্যাংকে৷ আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও আস্থা ও বিশ্বাসের বিনিময়ে কাগজপত্র জামানত রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেন ঋণগ্রহীতাদের হাতে৷ অথচ সেই আস্থা আর বিশ্বাসটা এখন প্রায় তলানিতে৷

এ জন্যই ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণমানের অবনমন হয়েছে৷ অন্যদিকে বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে৷ এর বেশিরভাগই আদায়যোগ্যতাও হারিয়েছে৷ প্রতি বছরই অনাদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণও বাড়ছে৷ এজন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলোতে ঋণ অবলোপন দেখাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়- ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যেও এখন আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে৷ এর ফলে গত সাত বছরে অন্তত ডজনখানেক এমডিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে৷ এ তালিকা থেকে বাদ যাননি চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও৷

ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো পুরোনো এবং ইসলামী ব্যাংকের মতো সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা৷ অবশ্য রাতারাতি তৈরি হয়নি এমন পরিস্থিতি৷ বছরের পর বছর অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতির বিচার না হওয়া এবং ব্যাংক খাতের ‘রাজনীতিকীকরণ’ই এর মূল কারণ৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে হাত করে ব্যবস্থাপনাকে পাশ কাটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা বের করে নিয়ে গেছেন৷ অবশ্য এত কিছুর পরও এ দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সাধারণ গ্রাহকরা মুখ ফিরিয়ে নেননি৷ এর কারণ হলো বিকল্প না থাকা৷ এখানে নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই সামান্য৷ আর ইনস্যুরেন্স খাতকে কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক খাত মনে করা হয় না৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একাধিক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও এ দেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি গত দেড় দশকে৷ অবশ্য পদ্মাব্যাংকসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক সূচকে এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সেগুলো বন্ধ করার উপক্রম হয়েছিল৷ তবুও সরকার এগুলোকে বন্ধ না করে উল্টো বিনিয়োগ করেছে৷ মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এটাকে অবশ্য এক ধরনের লাইফ সাপোর্টও বলা যেতে পারে৷

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ দাঁড়িয়েছে হাজার ৪৮ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা৷ আর বেসরকারি দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ৭ হাজার ২৭২ কোটি ৬ লাখ টাকা৷

এদিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে রাজনৈতিক বলয়ের কারণে৷ এমনকি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন তিনি গভর্নর৷ এই পদেও নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যা অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে৷ যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও পাবলিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারে না৷

এছাড়া ব্যাংক পরিচালকদের বেশিরভাগই শীর্ষ ব্যবসায়ী৷ এবং তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ এর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, ঋণ আদায়, ঋণের সুদহার বৃদ্ধি বা কমানো, খেলাপি ঘোষণা, ঋণ অবলোপন সবকিছুতেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাধান্য পেয়ে আসছে৷

এছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংকগুলোকে নিজেদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে এটাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেন৷ অথচ এখানে আমানতকারীদের স্বার্থ থাকে৷ সাধারণ গ্রাহকদের স্বার্থ থাকে৷ ব্যাংক তো অন্য দশটা কোম্পানির মতো নয় যে যা ইচ্ছা তা করা যাবে৷ এখানে কোনো কিছু করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে করতে হয়৷ কিন্তু সেটা মানা হয় না, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো রুলস-রেগুলেশন এখানে কাজে আসে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই৷ একই সঙ্গে অপরাধের শাস্তি বিধান করার পাশাপাশি অপরাধীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি৷ কিন্তু সেটা হয় না৷ বরং অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা মেরে দিয়ে নির্বিঘ্নে বিদেশে পালিয়ে যান এমন ঘটনাও ঘটেছে৷

এদিকে ব্যাংক খাতকে পুঁজি করে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়, যার প্রমাণও পেয়েছে বাংলাদেশ৷ অথচ সেসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷

সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৮২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা৷ তারা বলছেন, এটি পুরো ঘটনার ছোট একটি অংশ মাত্র৷ পাচারের আসল চিত্র আরও অনেক বড়৷

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একটি বিবৃতিতে আরও গভীর ও বিস্তৃত তদন্ত সাপেক্ষে অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে৷ মূল সমস্যা হলো- ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হবে, কিছু তদন্তও হবে, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না৷ দায়ী কোনো ব্যক্তির শাস্তিও হয় না- হবে না৷ ফলে কিছুদিন পর আবারও একই রকম ঘটনা ঘটবে৷ এটা যেন স্বাভাবিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা এবং ব্যাংক খাতের অভিভাবক হিসেবে কাজ করা৷ সম্প্রতি সেই মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির চাপ৷ একদিকে টানা কয়েক বছর ধরে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপও দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে, যা রীতিমতো সাংঘর্ষিক৷ মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বাইরে টাকার প্রবাহ বেড়েছে৷ ফলে জিনিসপত্রের দাম কোনোভাবেই কমছে না৷ ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ছে৷

জুন-২০২৩ পর্যন্ত মোট ছাপানো নোটের পরিমাণ ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বিপরীতে সার্কুলেশন তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা৷ সাধারণত দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংক শাখার ভল্টে থাকে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা৷ বাকি ২ লাখ ৯২ থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে৷

তবে এ কথা বলা যায় যে, করোনা মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছিল৷ এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের দর ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে৷ এ সময় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দরও বেড়েছে৷ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা এর আগের মাস জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ৷এর মানে, এক বছর আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, তার তুলনায় এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা বেশি৷ অথচ বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি৷ এতে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে৷

এছাড়া অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে৷ আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলা দুরুহ হয়ে পড়েছে৷ এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভুলনীতি৷ কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক নিকট অতীতে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল৷ ফলে ডলারের দর মুক্তবাজারে ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে দফায় দফায় কমেছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে ডলারের অফিসিয়াল রেট ১০৯ টাকা কিন্তু বাস্তবে ১১২ টাকা দিয়েও এলসি খোলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা৷ আর খোলা বাজারে তো ১১৭ টাকায়ও পাওয়া যায় না৷

ডয়চে ভেলে

এস. এ টিভি সমন্ধে

SATV (South Asian Television) is a privately owned ‘infotainment’ television channel in Bangladesh. It is the first ever station in Bangladesh using both HD and 3G Technology. The channel is owned by SA Group, one of the largest transportation and real estate groups of the country. SATV is the first channel to bring ‘Idol’ franchise in Bangladesh through Bangladeshi Idol.

যোগাযোগ

বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬,
গুলশান-১, ঢাকা-১২১২,
বাংলাদেশ।
ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০
ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪
ই-মেইল: info@satv.tv
ওয়েবসাইট: www.satv.tv

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩। বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ। ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০, ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত

আপডেট সময় : ০৯:৫০:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

টানা কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে৷ এ খাতে এখন তার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট৷

অথচ আর্থিক খাতের বড় শক্তিই হওয়ার কথা ছিল আস্থা ও বিশ্বাস৷ যেমন, আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে আমানতকারীরা তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ জমা রাখে ব্যাংকে৷ আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও আস্থা ও বিশ্বাসের বিনিময়ে কাগজপত্র জামানত রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেন ঋণগ্রহীতাদের হাতে৷ অথচ সেই আস্থা আর বিশ্বাসটা এখন প্রায় তলানিতে৷

এ জন্যই ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণমানের অবনমন হয়েছে৷ অন্যদিকে বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে৷ এর বেশিরভাগই আদায়যোগ্যতাও হারিয়েছে৷ প্রতি বছরই অনাদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণও বাড়ছে৷ এজন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলোতে ঋণ অবলোপন দেখাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়- ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যেও এখন আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে৷ এর ফলে গত সাত বছরে অন্তত ডজনখানেক এমডিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে৷ এ তালিকা থেকে বাদ যাননি চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও৷

ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো পুরোনো এবং ইসলামী ব্যাংকের মতো সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা৷ অবশ্য রাতারাতি তৈরি হয়নি এমন পরিস্থিতি৷ বছরের পর বছর অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতির বিচার না হওয়া এবং ব্যাংক খাতের ‘রাজনীতিকীকরণ’ই এর মূল কারণ৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে হাত করে ব্যবস্থাপনাকে পাশ কাটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা বের করে নিয়ে গেছেন৷ অবশ্য এত কিছুর পরও এ দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সাধারণ গ্রাহকরা মুখ ফিরিয়ে নেননি৷ এর কারণ হলো বিকল্প না থাকা৷ এখানে নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই সামান্য৷ আর ইনস্যুরেন্স খাতকে কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক খাত মনে করা হয় না৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একাধিক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও এ দেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি গত দেড় দশকে৷ অবশ্য পদ্মাব্যাংকসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক সূচকে এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সেগুলো বন্ধ করার উপক্রম হয়েছিল৷ তবুও সরকার এগুলোকে বন্ধ না করে উল্টো বিনিয়োগ করেছে৷ মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এটাকে অবশ্য এক ধরনের লাইফ সাপোর্টও বলা যেতে পারে৷

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ দাঁড়িয়েছে হাজার ৪৮ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা৷ আর বেসরকারি দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ৭ হাজার ২৭২ কোটি ৬ লাখ টাকা৷

এদিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে রাজনৈতিক বলয়ের কারণে৷ এমনকি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন তিনি গভর্নর৷ এই পদেও নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যা অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে৷ যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও পাবলিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারে না৷

এছাড়া ব্যাংক পরিচালকদের বেশিরভাগই শীর্ষ ব্যবসায়ী৷ এবং তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ এর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, ঋণ আদায়, ঋণের সুদহার বৃদ্ধি বা কমানো, খেলাপি ঘোষণা, ঋণ অবলোপন সবকিছুতেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাধান্য পেয়ে আসছে৷

এছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংকগুলোকে নিজেদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে এটাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেন৷ অথচ এখানে আমানতকারীদের স্বার্থ থাকে৷ সাধারণ গ্রাহকদের স্বার্থ থাকে৷ ব্যাংক তো অন্য দশটা কোম্পানির মতো নয় যে যা ইচ্ছা তা করা যাবে৷ এখানে কোনো কিছু করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে করতে হয়৷ কিন্তু সেটা মানা হয় না, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো রুলস-রেগুলেশন এখানে কাজে আসে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই৷ একই সঙ্গে অপরাধের শাস্তি বিধান করার পাশাপাশি অপরাধীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি৷ কিন্তু সেটা হয় না৷ বরং অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা মেরে দিয়ে নির্বিঘ্নে বিদেশে পালিয়ে যান এমন ঘটনাও ঘটেছে৷

এদিকে ব্যাংক খাতকে পুঁজি করে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়, যার প্রমাণও পেয়েছে বাংলাদেশ৷ অথচ সেসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷

সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৮২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা৷ তারা বলছেন, এটি পুরো ঘটনার ছোট একটি অংশ মাত্র৷ পাচারের আসল চিত্র আরও অনেক বড়৷

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একটি বিবৃতিতে আরও গভীর ও বিস্তৃত তদন্ত সাপেক্ষে অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে৷ মূল সমস্যা হলো- ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হবে, কিছু তদন্তও হবে, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না৷ দায়ী কোনো ব্যক্তির শাস্তিও হয় না- হবে না৷ ফলে কিছুদিন পর আবারও একই রকম ঘটনা ঘটবে৷ এটা যেন স্বাভাবিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা এবং ব্যাংক খাতের অভিভাবক হিসেবে কাজ করা৷ সম্প্রতি সেই মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির চাপ৷ একদিকে টানা কয়েক বছর ধরে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপও দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে, যা রীতিমতো সাংঘর্ষিক৷ মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বাইরে টাকার প্রবাহ বেড়েছে৷ ফলে জিনিসপত্রের দাম কোনোভাবেই কমছে না৷ ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ছে৷

জুন-২০২৩ পর্যন্ত মোট ছাপানো নোটের পরিমাণ ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বিপরীতে সার্কুলেশন তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা৷ সাধারণত দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংক শাখার ভল্টে থাকে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা৷ বাকি ২ লাখ ৯২ থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে৷

তবে এ কথা বলা যায় যে, করোনা মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছিল৷ এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের দর ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে৷ এ সময় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দরও বেড়েছে৷ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা এর আগের মাস জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ৷এর মানে, এক বছর আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, তার তুলনায় এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা বেশি৷ অথচ বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি৷ এতে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে৷

এছাড়া অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে৷ আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলা দুরুহ হয়ে পড়েছে৷ এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভুলনীতি৷ কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক নিকট অতীতে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল৷ ফলে ডলারের দর মুক্তবাজারে ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে দফায় দফায় কমেছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে ডলারের অফিসিয়াল রেট ১০৯ টাকা কিন্তু বাস্তবে ১১২ টাকা দিয়েও এলসি খোলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা৷ আর খোলা বাজারে তো ১১৭ টাকায়ও পাওয়া যায় না৷

ডয়চে ভেলে