ফেলানী হত্যা: ন্যায়বিচার মেলেনি, থামেনি সীমান্ত হত্যাও
- আপডেট সময় : ১২:০১:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩
- / ১৬২৪ বার পড়া হয়েছে
হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পেরুলেও কাঙ্খিত ন্যায়বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার৷ দুই দেশের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের পরও সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো বন্ধ করেনি ভারতীয় বাহিনী৷
কুড়িগ্রাম সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশের ছবি আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে৷ ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল৷ কিন্তু তাদের বিশেষ আদালতে অভিযুক্ত অমিয় ঘোষ দোষ স্বীকার করলেও বেকসুর খালাশ পেয়েছেন৷ পরে ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) মাধ্যমে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন৷ কয়েক দফা শুনানির দিন পিছিয়ে এখনও আদালতেই ঝুলে আছে পিটিশনটি৷ বিচারিক কাজ বিলম্বিত হলেও শেষ পর্যন্ত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রত্যাশা বিশিষ্টজনদের৷
ফেলানীর বাবা মো. নুরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফেলানীকে সঙ্গে করে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় আমার চোখের সামনে বিএসএফ আমার মেয়েকে হত্যা করেছে৷ পরে আমি জেনেছি, অমিয় ঘোষ নামে একজন বিএসএফ সদস্য ফেলানীকে গুলি করার কথা স্বীকার করেছে৷ অথচ আদালত তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে৷ আমি দুই বার ভারতে গিয়ে স্বাক্ষ্য দিয়েছি, ন্যায় বিচার চেয়েছি, অথচ তারা সঠিক বিচার করেনি৷ আমি অমিয় ঘোষের ফাঁসি চাই৷ আমি চাই ভারত সরকার যেন আমার মেয়ের সঠিক বিচারটা করে৷ কারণ আমার মেয়ে হত্যার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি মরলেও আমার আত্মা শান্তি পাবে না৷’’
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের নুরুল ইসলাম পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতে দিল্লিতে৷ মেয়ে ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয় বাংলাদেশে৷ বিয়ে দিতে ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি মেয়েকে সঙ্গে করে আসেন অনন্তপুর সীমান্তে৷ ৭ জানুয়ারি ভোরে দালালের মাধ্যমে ফুলবাড়ী অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে কাঁটাতারের ওপর মই বেয়ে নামার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ফেলানীর৷ দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে তার মরদেহ৷ আলোচিত এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি তার পরিবার৷
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফেলানীর ঘটনাটা মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন৷ আমাদেরও প্রত্যাশা ছিল, ন্যায় বিচার হবে৷ কিন্তু তাদের বিশেষ আদালত অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে খালাস দিয়ে দিয়েছে৷ সীমান্তে এই যে অবৈধ চোরাচালান হয়, এর জন্য তো শুধু এক পক্ষ নয়, উভয় পক্ষের দায় রয়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের বিজিবি কাউকে গুলি করে মারার খরব আমরা শুনিনি৷ বাংলাদেশের সরকার তো এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছে৷ কিন্তু ভারত সরকার উদ্যোগী না হলে আসলে কিছুই হবে না৷ আমরা প্রত্যাশা করি, দ্রুতই তারা এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন৷’’
ফেলানীর ঝুলে থাকার ছবি প্রচার হওয়ার পর গণমাধ্যমসহ মানবাধিকারকর্মীদের সমালোচনায় ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের বিএসএফ’র বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়৷ ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত৷ বিজিবির আপত্তিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু হলেও সেখানে খালাস দেওয়া হয় অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে৷ এরপর ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) মাধ্যমে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন৷ পিটিশনের ভিত্তিতে কয়েক দফায় শুনানির দিন পিছিয়ে এখনও আদালতেই ঝুলে আছে পিটিশনটি৷
কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর ও ফেলানীর বাবার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন একটি ঘটনা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকতে পারে না৷ এর সুরাহা হওয়া উচিৎ৷ আমি খুবই আশাবাদি দ্রুত এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে৷’’
তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা রিট পিটিশনের শুনানি এখনও শুরু হয়নি৷ তবে মহামারির শুরুর আগে তা একবার কার্যতালিকার উঠেছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি বিলম্ব হলেও ন্যায় বিচারের মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠা হবে৷ কারণ বিশ্বব্যাপী ভারতের সুপ্রীম কোর্টের ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত নানাভাবে আলোচিত হয়৷ শুধু এই হত্যার বিচার নয়, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কিভাবে আরও সুশৃঙ্খল করা যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা পাব বলে আমি আশা করি৷’’
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডনিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ ভারতের পক্ষ হত্যা বন্ধের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি৷ তবে আগে বছরে যেখানে বিএসএফের গুলিতে বছরে অর্ধশত বাংলাদেশি মারা যেতেন এখন তা কমে এসেছে৷ বিদায়ী বছরে এই সংখ্যা ছিল ১৫ জন৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে সীমান্তে মোট ১৬৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ এই সময়ে আহত হয়েছেন ১৪০ জন ৷ অপহৃত হয়েছেন ১১৯ জন৷ এর মধ্যে ২০২১ সালে হত্যা করা হয় ১৯ জনকে৷ ২০২০ সালে ৪৯ এবং ২০১৯ সালে ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন প্রাণ হারান৷
সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বর ভোরে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা সীমান্তে দুই বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন৷ তারা হলেন সাদিক হোসেন (২৩) এবং মংলু (৪০)৷ এই ঘটনায় আরো দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন৷
ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সচিব কিরীটি রায় কয়েকদিন আগে ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘দুই মাস আগেও বলা হয়েছে সীমান্ত হত্যা কমানো হবে৷ কিন্তু কমছে না৷ ভারতের সরকার বলছে বিএসএফ তাদের কথা শুনছে না৷ এটা কীভাবে সম্ভব! বাংলাদেশও এটা নিয়ে কিছু বলে না৷ কোনো জোরালো প্রতিবাদ করে না৷ তারা জো হজুর জি হুজুর করে৷ এভাবে করলে তো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না৷’’
বুধবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ও ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব একটি শান্ত, স্থিতিশীল ও অপরাধমুক্ত সীমান্ত নিশ্চিতে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ তবে সীমান্ত হত্যা দু’দেশের সম্পর্ককে বিব্রত করেছে৷’’
সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে যোগাযোগ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবকে পাওয়া যায়নি৷